পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৩৫৬

উইকিসংকলন থেকে
পরিভ্রমণে চলুন অনুসন্ধানে চলুন
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
331

সতর্কতায় পা ফেলে চলেছে ১২ জন বঙ্গ-জননীর বীর সন্তান। সামনে লক্ষ্য শুধু ব্রীজ বড়খাতা। তিন-তিনবার ফিরে গেছে মুক্তিবাহিনী। এবার তারা জীবন দেবে, তবু ব্রীজ অক্ষত রেখে যাবে না। কদম কদম পা ফেলে যখন তারা এগুচ্ছে, এলো আল্লাহর আর্শীবাদ, মূষলধারে বৃষ্টি। সেই বৃষ্টিকে সাথী করে গায়ের জামা খুলে 'এক্সপ্লোসিভ' গুলোকে জড়িয়ে নিয়ে এগিয়ে চললো ব্রীজ ‘বড়খাতার' দিকে। আকাশ ঘনিয়ে এলা অন্ধকারে। বৃষ্টির গতি গেল বেড়ে। ব্রীজ বড়খাতার ওপর চোখ পড়লো মুক্তিবাহিনীর। বৃষ্টিতে মুখ বুজে আছে পাকিস্তানীদের বাঙ্কারগুলো। ব্রীজের দুই মুখে পৌছে গেল হারেসউদ্দিন, মতিউর রহমান ও অন্য সাথীরা। রাত তখন দেড়টা হবে। পাঞ্জাবীরা বৃষ্টির মুখে বাঙ্কারে ঢুকে বসে আছে। তলায় ততক্ষণে ত্রস্ত হাতে ক্ষিপ্রগতিতে এগিয়ে চলেছে মুক্তিবাহিনী অপারেশন। ব্রীজের তিন জায়গায় এক্সপ্লোসিভ বাঁধা হলো। মূল প্লানে ছিল দুই জায়গায়। কিন্তু বৃষ্টির জন্য পাক-হানাদাররা যখন “ওয়াচ” করতে পারছে না কিছুই তখন মতিউর রহমান সেই সুযোগটা কাজে লাগালেন। মাত্র ২৫ মিনিটে ‘এক্সপ্লোসিভস' লাগানোর কাজ শেষ হয়, যেটার জন্য সময় দেয়া ছিল ৩০ মিনিট। এটা সম্ভব হলো কেননা মুক্তিবাহিনীর যেসব ছেলেদের তিস্তার পাড়ে গার্ড থাকার কথা ছিল তারা বরং ব্রীজের তলায় কাজ করে। বৃষ্টির সুবিধাটার জন্য সিদ্ধান্তটা অন দি স্পট চেঞ্জ করা হয়। এক কোম্পানী পাঞ্জাবী হানাদার ব্রীজের ওপর, ডানে-বামে দুর্ভেদ্য বাঙ্কারে বসে বসে যখন বৃষ্টির শব্দ শুনেছে, ততক্ষণে তাদের মৃত্যুঘণ্টা বেজে গেছে তিস্তা নদীর স্রোতের ওপর।

 অত্যন্ত সন্তর্পণে ধীরে ধীরে ক্যাপ্টেন মতিউর তিস্তার ওপর থেকে তুলে আনলেন তাঁর বারজন সাথীকে। গুনে গুনে নিলেন তিনি। হ্যাঁ, এবার পেছনে চলো সবাই। ৬০০ গজ দূরে এসে থামলেন তারা। সেই মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে রাত পৌনে দুটার দিকে ডেটনেটে আগুন ধরালেন তারা। প্রচণ্ড শব্দে, সেই বৃষ্টিপাতের মধ্যে মনে হলো আকাশ ভেঙ্গে রাশি রাশি বজ্রপাত হচ্ছে “ব্রীজ বড়খাতার” ওপর। তিস্তার বুকে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ভেঙ্গে পড়ছে হানাদারদের বাঙ্কার, ভেঙ্গে পড়ছে হানাদারদের শরীর। 'জয় বাংলা' ধ্বনি দিয়ে এল-এম-জি'র ফায়ার ওপেন করে দিল মতিউর হারেসরা। পেছন থেকে কভারিং ফায়ার এলো লেঃ মেজবাহউদ্দীনের কাছ থেকে। ছুটছে হানাদাররা, ব্রীজের চারপাশের বাঙ্কার ছেড়ে ভাগছে প্রাণভয়ে, ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে যাচ্ছে পেছন পানে। আক্রমণের আকস্মিকতায় ভীতসন্ত্রস্ত হানাদারদের ওপর বৃষ্টির ধারার মত গুলিবর্ষণ করে চলেছে বীর মতিউর, বীর হারেসরা। বাংলার দুশমনরা পেছনে ১৫টি ডেডবডি ফেলে রিট্রিট করলো। ব্রীজ বড়খাতার ওপারে উড়লো মুক্তির পতাকা। তিস্তার ওপাশ মুক্ত হয়ে গেল চিরতরে। যে ব্রীজের জন্য পাঞ্জাবীরা গর্ব করে বেড়াত, তাদের দালালরা যে “বড়খাতা ব্রীজের” কথা বলে মুক্তিবাহিনীর পরাজয়ের প্রমাণ খাড়া করতো সেই বড়খাতা ব্রীজের বিজয় যখন সম্পন্ন হলো আনন্দে আবেগে কাঁদলো ক্যাপ্টেন মতিউর, কাঁদলো হারেসরা। এক অপরকে জড়িয়ে ধরলো বুকে।

 যুদ্ধের ইতিহাসে “ব্রীজ রিভার অন কাউয়াই” এর নাম যদি থাকে, থাকবে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের গাঁথা নিয়ে “ব্রীজ রিভার অন তিস্তা”র নাম।

॥ চার রাত্রির কাহিনী ॥

 ক'জন জানেন যে, আমাদের ৩১৫ জন মুক্তিযোদ্ধা ৪ দিন আটকা পড়ে শুধু বিস্কিট আর পানি খেয়ে বেঁচে ছিল? ৬নং এইচ-কিউ-তে বসে সেক্টর কমাণ্ডার খাদেমুল বাশার সাহেব পর্যন্ত প্রায় ধরে নিয়েছিলেন তারা মারা গেছে।

 সেই ‘দুঃখের চার রাত' ছিল ৩রা সেপ্টেম্বর থেকে ৭ই সেপ্টেম্বরের রাত। এই রাতের শুরু হয়েছিল আরো আগে তিস্তার গা বেয়ে শঠিবাড়ি বন্দরের বুকে।

 মুক্তিবাহিনীর পজিশন ছিল শঠিবাড়ির উত্তর ও পূর্ব দিকে। তাদের এক মাইল পেছনে তিস্তা নদী বয়ে চলেছে। তিস্তা নদীর অপর পাড়ে পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে এফ-এফ কোম্পানী নং ৭-এর কমাণ্ডার হারেসউদ্দিন