আরো কয়েকখানি জাহাজ ও বার্জ এদিক-ওদিক রয়েছে। নেভাল জেটিতে ছিলো দু'টি গানবোট এবং একখানি বার্জ। সন্ধ্যার পরই গানবোট দুটি অজ্ঞাত স্থানে অভিমুখে রওয়ানা হয়ে যায়। আমাদের ছেলেদের কপাল খারাপ। এমন সুন্দর দুটি শিকার হাতছাড়া হলো। রাত সোয়া আটটা। আল-আববাস এবং হরমুজের মাস্টার এবং ক্রুরা গভীর নিদ্রায় অচেতন। পাহারাদার এবং মিলিটারী সান্ত্রী আধো ঘুম আধো জাগরণে ঢুলছে। রাত দুটো বাজলেই তাদের ডিউটি শেষ। আর মাত্র ৪৫ মিনিট বাকী। তারপর অন্যরা আসবে।
মাথাটা পানির ওপরে রেখে ততক্ষণে আমাদের ছেলেরা যার যার লক্ষবস্তুর কাছে পৌঁছে গেছে। কালবিলম্ব না করে তারা জাহাজগুলোর গায়ে লিমপেট মাইন লাগিয়ে গিয়েই আবার তেমনি নিঃশব্দে নদীর ভাটিতে ভেসে যায়। আরো দক্ষিনে সরে গিয়ে তারা পূর্ব তীরে উঠে পড়ে। রাত পোহাতে তখনো অনেক বাকী। নিরাপদ দূরত্বে সরে যাবার পর্যাপ্ত সময় তারা পেয়ে যায়। সকাল নাগাদ তারা পটিয়া এবং সেখানে সারাদিন বিশ্রাম নিয়ে ১ নম্বর সেক্টর হেডকোয়ার্টার হরিণার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে।
রাত ১টা ৪০ মিনিট। হঠাৎ কান ফাটানো আওয়াজে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম কেঁপে ওঠে। লোকজন শয্যা থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়ে। শিশুরা ভয়ে কান্না শুরু করে। কিন্তু কি ঘটছে কেউ তা বলতে পারে না।
১টা ৪৫ মিনিট। আরেকটি প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। তারপর তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম। একটির পর একটি বিস্ফোরণে চট্টগ্রাম তখন থর থর করে কাঁপছে। আতংক ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। সান্ত্রীরা দিকবিদিক জ্ঞান হারিয়ে পাগলের মতো ইতস্তত বিক্ষিপ্ত গুলি ছুড়তে শুরু করে। ৬ নম্বর ওরিয়েণ্ট বার্জ দেখতে না দেখতে তলিয়ে গেল। আল-আববাস এবং হরমুজও দ্রুত ডুবতে থাকে। জাহাজের খোলে প্রচণ্ড বেগে তখন পানি ঢুকছে। আশেপাশের জাহাজ ও বার্জগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত। বিস্ফোরণে জাহাজের ক্রুদেরও অনেকে হতাহত হয়। কিন্তু ভয়ে কেউ সাহায্যের জন্য ওদিকে অগ্রসর হচ্ছে না, পাছে আবার বিস্ফোরণ শুরু হয়ে যায়।
সূর্যোদয়ের সাথে সাথেই সিনিয়র অফিসাররা দ্রুত বন্দরে গিয়ে উপস্থিত হন। সমগ্র এলাকায় সান্ধ্য আইন জারি করা হলো। মুক্তিবাহিনীর খোঁজে হেলিকপ্টারগুলো তখন আকাশে উঠে গেছে। পাকিস্তানীরা তাদের জিঘাংসা মেটাতে নদীর পূর্ব পাড়ের জনপদগুলোর উপর নির্বিচারে কামানের গোলাবর্ষণ করতে থাকে। নদীর পাড়ের গ্রামগুলোতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। সন্দেহের বশবর্তী হয়ে নিরপরাধ গ্রামবাসী এবং জেলেদের ধরে এনে মুক্তিবাহিনীর খবর বের করার বহু চেষ্টা হয়। শেষে কিছু না পেয়ে নদীর পাড়ে দাঁড় করিয়ে তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়। নিরপরাধ নিরস্ত্র গ্রামবাসী আর জেলেদের রক্তাক্ত লাশগুলো স্রোতের টানে ভেসে চলে সমুদ্রের দিকে।
পটিয়াতে আমাদের যোদ্ধারা তখন বিশ্রাম নিচ্ছিলো। তারা একটি অতি বিপজ্জনক ও জটিল 'মিশন' সফল করেছে। তাদের এ সফল অভিযান স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে একটি বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
ভোর তখন পাঁচটা। ঢাকাস্থ ইস্টার্ন কমাণ্ড হেডকোয়ার্টারের অপারেশন রুমে কর্তব্যরত স্টাফ অফিসার ঘটনার বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ না করেই সত্বর ঘটনা সম্পর্কে 'কোর' কমাণ্ডারকে অবিহিত করার সিদ্ধান্ত নেন। গেরিলাদের চাঁদপুর এবং মঙ্গলা বন্দরের হামলার খবরও কুমিল্লা এবং যশোর সেনানিবাস থেকে তড়িৎগতিতে হেডকোয়ার্টারে পাঠানো হয়। এই সকল আক্রমণে একদিকে যেমন শত্রুর বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি হয়, অপরদিকে পাকিস্তানীদের মিথ্যা দম্ভ আর অহমিক হয় ধূলিসাৎ। অপারেশন জ্যাকপট সফল হয় পুরোপুরিভাবে।
এদিনের ঘটনা সম্পর্কে ১৬ই আগস্ট পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর তদন্ত রিপোর্ট লেখা হয়েছিলো; “পরিস্থিতি পর্যালোচনার প্রেক্ষাপটে ক্ষয়ক্ষতি এবং হতাহতের ব্যাপারে জাহাজের কোন ব্যক্তিকেই দায়ী করা চলে না। কারণ পূর্ব থেকে কিছুই টের পাওয়া যায়নি এবং গেরিলারা যে এমন ধরনের অভিযান চালাতে পারে বা চালাবে তা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। অবশ্য নদীর দিকটা ভাল করে দেখাশোনার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। দিন-