পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৩৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
13

রাত্রির কোন সময়েই কোন নৌকা ইত্যাদিকে আর জাহাজগুলোর ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দেয়া হচ্ছে না।” (পাক সেনাবাহিনীর তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট থেকে উদ্ধৃত)।

 সামুদ্রিক ও নদীবন্দরগুলোর উপর এই চমকপ্রদ সফল হামলা পাকিস্তানীদের হকচকিত করে দিয়েছিলো। এমন একটা দুঃসাহসী অভিযান মুক্তিযোদ্ধারা চালাতে পারে এটা ছিলো পাকিস্তানীদের চিন্তারও বাইরে। এই হামলার আগ পর্যন্ত আমাদের যুদ্ধের পদ্ধতি সম্পর্কে পাকিস্তনীরা মোটামুটি পরিচিত হয়ে উঠেছিলো। সারা দেশ জুড়ে এ সময়ে মুক্তিযোদ্ধারা অসংখ্য ছোট ছোট হামলা চালায়। কিন্তু জুন-জুলাই মাসের এইসব ছোট ছোট হামলাগুলি ছিলো কম তাৎপর্যপূর্ণ। হ্যাণ্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ, শত্রুর গাড়ি ধ্বংস, রাজাকার, দালাল, শান্তিবাহিনী বা আলবদর, আলশামস-এর লোকজন হত্যার মধ্যে এ সময়ের ঘটনাবলী সীমিত ছিলো। কোন গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যবস্তুর ওপর তখনও হামলা চালানো হয়নি। শত্রুপক্ষের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও ছিলো তখন পর্যন্ত অক্ষত। এমন কি নেতৃস্থানীয় বাঙালী দালালরা পর্যন্ত বেশ আয়েশের সাথে তাদের দৈনন্দিন কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছিলো। মাঝে- মধ্যে এদের ওপর পরিকল্পনাহীন কয়েকটি হামলা হলেও তা ব্যর্থ হয়ে গেছে। মাঝখান থেকে গেরিলারা ধরা পড়ে পাকিস্তানীদের হাতে প্রাণ দিয়েছে।

 রণকৌশলের দিক থেকে শত্রুপক্ষের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রসমূহ বিভিন্ন হেডকোয়ার্টার, অফিসার মেস, অস্ত্র ও রসদ গুদাম, বিদ্যুৎ ও জ্বালানী কেন্দ্র, বন্দর, রেলওয়ে-এসবের উপর আগস্ট পর্যন্ত কোন সুপরিকল্পিত 'গেরিলা' হামলা চালানো হয়নি। ফলে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহলে বাংলাদেশ প্রশ্ন মৃতপ্রায় হয়ে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের এবং দেশের মানুষের মনোবল কিছুটা যেন ভেঙ্গে পড়ে।

 অন্যদিকে পাক-বাহিনীর অবস্থা তখন বেশ সুবিধাজনক। যুদ্ধের প্রথমদিকে আমাদের নিয়মিত বাহিনী তাদের বেশ কিছু ক্ষতি করেছিলো। শত্রুপক্ষে হতাহতের সংখ্যাও ছিলো প্রচুর। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া খবরে মোটামুটি জানা যায়, পাঁচ থেকে ছয় হাজার শত্রুসৈন্য নিহত এবং আট থেকে দশ হাজার তখন আহত হয়েছিলো। আহতদের মধ্যে অন্তত এক-তৃতীয়াংশ পুনরায় যুদ্ধ করার অনুপযুক্ত হয়েছিলো।

সামরিকভাবে গেরিলা তৎপরতা সন্তোষজক না হলেও ভবিষ্যতের জন্য আমরা অবশ্যই আশাবাদী ছিলাম। মুক্তিযোদ্ধারা সম্পূর্ণ প্রচলিত পদ্ধতিতে দু' থেকে তিন সপ্তাহের ট্রেনিং পেত এবং ট্রেনিং শেষ করেই বাংলাদেশের অভ্যান্তরে তাদেরকে গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ করতে হতো। তাছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায় সবারই বয়স কম, আবেগ বেশী। কেউ কেউ আবার অতিরিক্ত উচ্চভিলাষী। এরা প্রত্যেকেই গ্রুপ লিডার কিংবা ঐ ধরনের কিছু একটা হতে চাইতো। এটা বুঝতে চাইতো না যে সবাই “লিডার” হলে অনুসারী কোথা থেকে আসবে। অবশ্য যুদ্ধ সম্পর্কে আমাদের সকলের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত এর চাইতে বেশী কিছু আমাদের আশা করার ছিলো না।

 এমনি যখন আমাদের অবস্থা যে সময়ে অপারেশন 'জ্যাকপট'-এর সাফল্য একথা প্রমাণ করেছিলো যে, যথাযথ শিক্ষা এবং নেতৃত্ব দিতে পারলে আমাদের ছেলেরাও অবিশ্বস্য কাজ করতে পারে। তাদের মধ্যে আন্তরিকতার কোন অভাব ছিলো না। তারা বুদ্ধিমান, কোন পরিস্থিতিতে কি করতে হবে দ্রুত তা বুঝে নিতেও সক্ষম। তাদের মানসিক উৎকর্ষ ছিলো নিঃসন্দেহে নিরক্ষর পাকিস্তানী সৈন্যদের চাইতে উত্তম। শিক্ষিত এক বিরাট গেরিলা বাহিনী আমরা পেয়েছিলাম, এটা আমাদের সৌভাগ্য।...

 সেপ্টেম্বর থেকে প্রতি মাসে ২০ হাজার গেরিলাকে ট্রেনিং প্রদান করে তাদেরকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই হিসাবে '৭১- এর ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশে গেরিলাদের সংখ্যা অনুমান করা হয় এক লাখের ওপরে। এদের মধ্যে শতকরা ৩০ ভাগ যথাযথভাবে কাজ করলেও পাক বাহিনীর সময় পরিকল্পনায় একটা ভাঙ্গন ধরানো সম্ভব। এই পরিস্থিতিতে গেরিলাদের নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হবে পাকিস্তানী