পরের দিন রাত্রি ১১টার সময় সৈন্যবাহী ট্রেনটি সুখানপুকুর ষ্টেশন অতিক্রম করিবে জানিতে পারিয়া মুক্তিবাহিনী সরকার-বাড়ির অর্ধ মাইল দক্ষিণে মাইন পুঁতিয়া রাখে। মাইন বিস্ফোরণে সৈন্যবাহী ট্রেনটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ফলে ৪ জন পাক ইঞ্জিনিয়ারসহ ১৪৬ জন পাকসেনা নিহত হয়।
অক্টোবর মাসের মধ্যভাগে ওয়াপদার নিকট কৈচোর রেললাইনের ব্রীজের দুই পাশে মাসুদ হোসেন আলমগীর (নবেল) মাত্র ৬ জন সঙ্গী লইয়া পাকবাহিনীর উপর আক্রমণ চালায়। বহু গুলি বিনিময়ের পর ৬ জন খানসেনা ও ১০ জন রাজাকার নিহত হয় এবং কতকগুলি পাকসৈন্য অস্ত্রশস্ত্র ফেলিয়া কাহালুর দিকে পালাইতে বাধ্য হয়।
অক্টোবর মাসের মধ্যভাগে মুক্তিবাহিনীর দল গাবতলী থানার জয়ভোগা গ্রামের নিকটস্থ সারিয়াকান্দি রোডের উপর মাইন পুঁতিয়া রাখিয়া যায়। পরে তাহা বিস্ফোরণ ঘটিয়া ৫ জন পাকসৈন্যের মধ্যে ৩ জন নিহত ও ২ জন আহত হয়।
১৮ই অক্টোবর বগুড়া শহরের পশু ডাক্তার থানার নিকটস্থ ট্রান্সমিটারটি গ্রেনেড দ্বারা ধ্বংস করিবার জন্য গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। ফলে ট্রান্সমিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পার্শবর্তী দোকানদার মুন্সী নজরুল ইসলামকে বর্বর হানাদারবাহিনী ধরিয়া ক্যাম্পে লইয়া যায়। ৪ দিন অমানুষিক নির্যাতন করার পর মুক্তি দেয়।
২০শে অক্টোবর নারচী ও পার্শববর্তী গণকপাড়া গ্রামে পাকসৈন্যদের সহিত গেরিলা বাহিনীর চারটি দলের এক ভীষণ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে সকাল ৭টা হইতে পরের দিন সকাল ৭ পর্যন্ত চলে। এইসব দলের মধ্যে তোফাজ্জল হোসেন মকবুল (চরহরিন), সৈয়দ ফজলুল আহসান দিপু, শোকরানা (রানা), আবদুস সালাম (বুলবুল), রেজাউল বাকী, গোলাম মোস্তফা (গাবতলী), কামাল পাশা (বৃন্দাবনপাড়া), রিজাউল হক মঞ্জু (ধাওয়া), স্বপন এবং হুয়াকুয়ার রেজাউল করিম মণ্টু, আখতার হোসেন বুলু, আতোয়ার হোসেন গামা, আবদুর রাজ্জাক হাঞ্জু, আবদুল বারী ও আরও অন্যান্য গেরিলাদের সহিত পাকবাহিনীর প্রচণ্ড গোলাগুলি বিনিময় হয়। সেই সময় গ্রামের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে জীবনের ভয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে গ্রাম ছাড়িয়া পালাইতে থাকে, তখন এলোপাতাড়ি গুলি চলিতে থাকে। পাকসেনার দল দিপুর দলকে ঘিরিয়া ফেলে। উপায়ান্তর না দেখিয়া দিপুর দল গ্রেনেড নিক্ষেপ করিয়া ধূম্রজাল সৃষ্টি করিতে বাধ্য হয়। তৎপর গণকপাড়া ঈদগাহ মাঠে গেরিলাবাহিনী পজিশন লইয়া তুমুল গোলাগুলি বর্ষণ করিতে থাকে। পাকসৈন্যরা আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র দ্বারা প্রবল আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে গেরিলা বাহিনী টিকতে না পারিয়া অবস্থান পরিবর্তন করিতে বাধ্য হয়। এমতাবস্থায় বহু বাড়ি জ্বালাইয়া-পোড়াইয়া দেয়। এদিকে শোকরানা রানার দল ও অন্যান্য দলের ৫০/৬০ জন গেরিলা যোদ্ধা টিউরপাড়া গ্রামের দিকে অগ্রসর হইয়া পজিশন নেয়। হানাদারবাহিনীর সহিত গেরিলাবাহিনীর পাল্টা গোলাগুলি চলিতে থাকে। ঐ সময় হানাদারবাহিনীর টিউরপাড়া গ্রামের ১২ জন গ্রামবাসীকে গুলি করিয়া হত্যা করে। গেরিলাবাহিনীর গোলাগুলিতে পাকবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেনসহ ৯ জন নিহত হয়। তৎপর সারা রাত্রি পাকবাহিনীর সহিত গেরিলাবাহিনী বাঁশগাড়ি ও নারচীতে প্রচণ্ড গোলাগুলি চলার পর ভোরবেলা পাকবাহিনী ছত্রভঙ্গ হইয়া পলায়ন করে। এই ঘটনার দুই দিন পরে তিন দিক হইতে পাকসেনা নারচী গ্রামে প্রবেশ করিয়া গ্রামের বহু বাড়িঘর পুড়িয়া ভস্মীভূত করে।
১০ই নভেম্বর নারচীর আবদুল হাসিম বাবলুর দল বগুড়া সারিয়াকান্দি রোডের বাইগুনী গ্রামে মাইন বিস্ফোরণ ঘটাইয়া কর্নেলসহ ৫ জন পাকসৈন্য নিহত করে। ঐ দিন গেরিলাবাহিনীর কমাণ্ডার মীর মঞ্জুরুল হক সূফীর নেতৃত্বে বগুড়া শহরের নিশিন্দারায় ১১ হাজার কিলোওয়াট ভোল্টের ট্রান্সমিটার ধ্বংস করা হয়।
১২ই নভেম্বর ইণ্ডিয়ান মারহাট্টা রেজিমেণ্ট, আসাম রেজিমেণ্ট ও মুক্তিযোদ্ধারা হিলি সীমান্তে পাকবাহিনীর সহিত মোকাবিলা করার জন্য উপস্থিত হয়। হিলিতে পাকবাহিনী তখন ঘোড়াঘাট হইতে ফ্রণ্টিয়ার ফোর্স আনিয়া।