পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৩৮৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
361

 পাল্টা আক্রমণ করিবার প্রস্তুতি নেয়। তখন ৬নং আসাম রেজিমেণ্টের ক্যাপ্টেন রায়সিং ডোগরা ও মুক্তিযোদ্ধাদের এস, এম ফারুক (বগুড়া), আবুল কাশেম (জয়পুরহাট), মোজাহার (গাবতলী), মোস্তফা রেজানুর (দিনাজপুর) দলের নেতৃত্বে পাকবাহিনীর সহিত প্রবল যুদ্ধ সংগঠিত হয়। এই যুদ্ধে বহু পাকসৈন্য ও কিছুসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা নিহত হয়। পাকসৈন্যদের সঙ্গে মেশিনগান, ভারী কামান, ট্যাঙ্ক এবং বিমানবিধ্বংসী কামান ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে স্টেনগান টমিগান, রাইফেল প্রভৃতির দ্বারা যুদ্ধ চলে। ঐ দিন বিমান হইতে প্রচণ্ড বোমাবর্ষণ হয়।

 ১৩ই নভেম্বর মহিমাগঞ্জের দুলুর নেতৃত্বে ও সিহিপুরের বাবলু, খালেক, হামিদ, খলিল, নূরুল, শুকু ফিনু, জগলু, হাল্লু, লিণ্টু ও আরও অনেকের সহযোগিতায় সুখানপুকুর রেল স্টেশনের ধারে শিহিপুরের নিকট একটি পাকসৈন্যবাহী স্পেশাল ট্রেন ডিনামাইট দ্বারা ধ্বংস করিয়া দেয়। ফলে প্রায় দেড়শত পাকসৈন্য মৃত্যুবরণ করে।

 ১৫ই নভেম্বর গেরিলা বাহিনী কমাণ্ডার মীর মঞ্জুরুল হক সুফীর নেতৃত্বে সুখানপুকুর রেলস্টেশনে শত্রুদের খাদ্যবাহী একটি ট্রেন মাইন বিস্ফোরণ ঘটাইয়া ধ্বংস করে।

 ২৫শে নভেম্বর গাবতলীর নিকটস্থ জয়ভোগ গ্রামের রেলওয়ে ব্রীজ পাকবাহিনীর নিকট হইতে দখল করিবার জন্য একদল মুক্তিযোদ্ধা পাকসৈন্যদিগকে আক্রমণ করিয়া গুলি বিনিময় করিতে থাকে। ফলে পাকসৈন্যরা গাবতলী থানাস্থ ক্যাম্পের দিকে পলায়ন করিতে বাধ্য হয়। দুই ঘণ্টা পর পাকসৈন্য বোঝাই একটি ট্রেন গাবতলী স্টেশনে থামিলে পাকসৈন্যরা ট্রেন হইতে নামিয়া জয়ভোগা ও বইগুনী গ্রামের দিকে গুলীবর্ষণ করিতে করিতে অগ্রসর হয়। ফলে বাইগুনী গ্রামের আবুল হোসেনসহ কয়েকজন গ্রামবাসী গুলির আঘাতে নিহত হয়। পরে নেপালতলী গ্রামের দিক হইতে গেরিলাবাহিনীর একটি দল আসিয়া পাল্টা আক্রমণ করিবার ফলে পাকসৈন্যরা গাবতলী ক্যাম্পে ফিরিয়া যাইতে বাধ্য হয়।

 ২৮শে নভেম্বর সারিকান্দি থানা আক্রমণ করা হয়। এই আক্রমণের নেতৃত্ব দেয় নারচীর আবদুল হাসিম বাবলু, আবদুর রশিদ, চরহরিণার তোফাজ্জেল হোসেন মকবুল, হুয়াকুয়ার আবদুর রাজ্জাক, রামচন্দ্রপুরের মহসিন। মৌরের চরের সরুজ্জামান। ৭নং সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধা দল ও গেরিলাবাহিনী প্রবল গোলাবর্ষণ করে। পাকবাহিনী পাল্টা আক্রমণ চালাইবার ফলে দুইজন পাকসৈন্য নিহত হয়। গেরিলাবাহিনী অদম্য সাহসে মাতৃভূমির পবিত্র মাটি থেকে বর্বর পাকবাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করার দৃপ্ত পণ লইয়া যুদ্ধ করিতে থাকে। বেলা ১১টার সময় ব্রাশফায়ারে কয়েকজন পাকসৈন্য মাটিতে পড়িয়া যায়।

 পরের দিন সকাল ৮টায় গেরিলা বাহিনী সারিয়াকান্দী থানা পুনঃ আক্রমণ করিয়া ৪৪ জন রাজাকারকে নিহত করে। থানার অফিসার ইনচার্জসহ ১৮জন পাকসৈন্য নিহত হয়। এই প্রচণ্ড গোলাগুলির ফলে গেরিলা বাহিনীর ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়। সমস্ত দিবারাত্রি প্রচণ্ড গোলাগুলি চলিতে থাকে।

 গেরিলা বাহিনীর খাদ্য ও পানীয় সরবরাহে কোন অসুবিধা হয় নাই। পার্শববর্তী গ্রামের জনসাধারণ স্বতঃস্ফূর্ত হইয়া খাদ্যদি সরবরাহ করিতে থাকে। পরিশেষে রাজাকার ও পুলিশেরা আত্মসমর্পন করে। কিছুসংখ্যক পুলিশ অন্ধকারে গ্রামের দিকে পলাইয়া প্রাণ রক্ষা করে। গেরিলা বাহিনীর যে ৩ জন শহীদ হয় তাহারা হইতেছেন বালিয়ার তাইরের মমতাজ উদ্দীন, সাত বেকীর মোজাম্মেল হক ও আর একজন। এই প্রচণ্ড যুদ্ধে সারিয়াকান্দি থানা দখল হয়। গেরিলা বাহিনী কর্তৃক ৫৩ জন রাজাকার ও ১৯ জন পুলিশ বন্দী হয়। ১৯জন রাজাকারকে গুলী করিয়া হত্যা করে। গেরিলা বাহিনী ১১৮ টি রাইফেল, ৪২টি এলএমজি, ১টি রিভলবার, ১টি গ্রেডে ও বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ উদ্ধার করে। ঐদিন বিমান আক্রমণ হয়, তাহার ফলে কয়েকজন জনসাধারণ নিহত হয়। জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মমতাজ উদ্দীনের দল এই সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে।