পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৩৮৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
362

 নভেম্বর মাসের শেষভাগে পাকসৈন্যরা ভেরুরপাড়া রেলস্টেশনে যাইবার কালে পথিমধ্যে ট্রেন থামাইয়া জোড়গাছা গ্রামের কতকগুলি বাড়ীতে আগুন জ্বালাইয়া দেয়। সংবাদ পাইয়া পার্শ্ববর্তী গ্রাম হইতে মুক্তিযোদ্ধা দল আসিয়া হানাদার বাহিনীকে ঘিরিয়া ফেলিয়া গোলাগুলিবর্ষণ করিতে থাকে। পাক সৈন্যরা ভীতসন্ত্রস্ত হইয়া দৌড়াইয়া ভেলুরপাড়া স্টেশনে বাঙ্কার আশ্রয় লয়। মুক্তিযোদ্ধাগণ সেখানেও তাহাদিগকে ঘিরিয়া ফেলিয়া গুলিবর্ষণ করিতে থাকে। ফলে ৪ জন পাক সৈন্য নিহত হয়।

 পরের দিন মুক্তিবাহিনীর কমাণ্ডার হুয়াকুয়ার রেজাউল করিম মণ্টুর নেতৃত্বে আব্দুস সালাম, আতোয়ার হোসেন প্রভৃতি এবং স্থানীয় গেরিলা বাহিনী ও জনসাধারণ রেল স্টেশনটি পোড়াইয়া দেয়। পরে চকচকে ব্রীজে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করিয়া ফেলে। তৎপর রেলওয়ে স্লিপার উঠাইয়া রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করিয়া দেয়।

 ডিসেম্বর মাসের প্রথমভাগে রংপুর পলাশ বাড়ী হইতে পলাতক একদল শত্রুসৈন্য গাবতলী থানার রামেশ্বরপুর গ্রামে প্রবেশ করিয়া গ্রামবাসীর উপর অত্যাচার শুরু করে। পার্শ্ববর্তী গ্রাম জাগুলির প্রাক্তন সৈনিক গোলাম ছারওয়ার খানের নেতৃত্বে তাহার দল প্রতিরোধ আক্রমণ চালায়। ইহাতে প্রচুর গোলাগুলির বিনিময় হয়। ফলে ২ জন শত্রুসৈন্য নিহত, ২ জন শত্রুসৈন্য আহত ও ১২ জন পাক সৈন্য আত্মসমর্পণ করিতে বাধ্য হয়। এই ঘটনার পূর্ব দিন সকাল বেলা পীরগাছা মিলিটারী ক্যাম্প হইতে একটি সৈনিক প্রাণের ভয়ে পালাইয়া আসিলে লস্করী পাড়ার নিকটস্থ জেলা বোর্ডের রাস্তার ব্রীজের নিকট শফিউল আলম স্টেনগানের গুলীতে তাহাকে নিহত করে। ঐদিন মহাস্থান হইতে ৫ জন হানাদার সৈন্য পালাইয়া আসিবার কালে গাবতলী থানার কদমতলী গ্রামে প্রবেশ করিবার সময় ৭ জন গ্রামবাসীকে গুলি করিয়া হত্যা করে। ঐ সময় চরহরিণার তোফাজ্জল হোসেন মকবুল ও তাহার দল ৫ জন পাক সৈন্যকে ধরিয়া ঘটনাস্থলেই গুলি করিয়া হত্যা করে।

 ৪ঠা ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর কমাণ্ডার জাহেদুর রহমান (বাদল) ও আরও অনেকে রংপুর জেলার ভরতখালি বাঁধের পার্শ্বে পাকসৈন্যদের সহিত এক সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ফলে রাজাকারসহ ৭ জন পাকসেনা নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে জাহেদুর রহমানসহ ৫ জন শহীদ হয়। এই ৫ জনের লাশ ভরতখালী স্কুল প্রাঙ্গণে কবরস্থ করা হয়।

 ৬ই ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর কামার আবুল হোসেন (কলসা)-এর নেতৃত্বে তাহার দল পাকহানাদার বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে। তুমুল লড়াইয়ের পর পাক সৈন্যরা নওগা অভিমুখে পশ্চাদপসরণ করে। কিছুসংখ্যক পাকসৈন্য হতাহত হয়।

 ১০ই ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী সম্মিলিত বিমান আক্রমণে সান্তাহার রেলওয়ে জংশন পাওয়ার হাউস মেকানিক্যাল ওয়ার্কস ও রেলওয়ে জংশন লোকোশেডের উপর বোমাবর্ষণ করে। ফলে কিছু পাকসৈন্য হতাহত হয়। যুক্তিবাহিনীর আনসার আলী নামে একজন বিমান কর্মচারী আহত হন।

 ১২ই ডিসেম্বর ভারতীয় মিত্রবাহিনী রংপুরের পলাশবাড়ী অতিক্রম করার পর পাকসৈন্য ভীতসন্ত্রস্ত হইয়া দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হইয়া পড়ে। তাহারা বগুড়া শহরের এতিমখানা হইতে অনবরত শেলবর্ষণ করিতে থাকে। তাহার ফলে পার্শ্ববর্তী গ্রামসমূহের বহু লোক হতাহত হয়। উপর হইতে ভারতীয় বিমান বাহিনী ঘন ঘন বোমাবর্ষণ করিতে থাকে। তখন পাক সৈন্যরা বাঙ্কারে লুকাইয়া পড়ে। কিছু পাকসৈন্য পালাইয়া গ্রামের দিকে ধাবিত হয়। গ্রামবাসী তাহাদিগকে ধরিয়া যে যেখানে পারে হত্যা করে।

 ১৩ই ডিসেম্বর কিছুসংখ্যক সৈন্য জয়পুরহাট হইতে পালাইয়া আসিয়া সদর থানার সরলপুর গ্রামের পাঁচ পীরের দরগায় আশ্রয় নেয়। মুক্তিফৌজের কমাণ্ডার আবদুস সোবহান খান বাবুল ও তাহার দল জানিতে পারিয়া তাহাদিগকে ঘেরাও করিয়া ফেলে। মুক্তিফৌজের সহিত প্রচণ্ড গোলাগুলিতে দুইজন মুক্তিসেনা ঘটনাস্থলে শহীদ হন। তন্মধ্যে ছিলেন মুক্তিফৌজের কমাণ্ডার আবদুস সোবহান খান বাবুল। পার্শ্ববর্তী গ্রামের লোকজন দা, কুড়াল খন্তা প্রভৃতি অস্ত্র লইয়া আসিয়া পাক বাহিনীর সমস্ত সৈন্যকে হত্যা করে।