পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৩৮৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
363

 ঐদিন গাবতলী থানার কদমতলী গ্রামে পীরগাছা মিলিটারী ক্যাম্প হইতে কয়েকজন পাকসৈন্য পালাইয়া আসিবার সময় কদমতলী গ্রামের রহিমউদ্দিন প্রামানিক নামে একজন লোক ভিটার মধ্যে মিলিটারীর ভয়ে হামাগুড়ি দিয়া লুকাইয়া থাকে। তখন একজন মিলিটারী তাহার পিঠে গুলি করে। তাহার পাশেই গোবর্ধন রবিদাস নামে একজন মুচিকে গুলি করিয়া হত্যা করে। নিকটস্থ গেরিলা বাহিনী আসিয়া তাহাদিগকে ঘিরিয়া ফেলে।

 প্রচণ্ড গোলাগুলি হওয়ার পর পাকসৈন্যদের একজন নিহত হয়। বাকী পাক সৈন্যরা একটি গর্তের মধ্যে লুকাইয়া পড়ে। পরে তাহারা সন্ধ্যার পর পালাইয়া যায়। ঘটনাস্থলে সারিয়াকান্দি থানার বোহালী গ্রামের রফিক নামে একজন মুক্তিসেনা শহীদ হন। এই প্রচণ্ড লড়াইয়ে হাট ফুলবাড়ী, জাতহলিদা, বাইগুলি ও নারচী গ্রামের গেরিলা বাহিনী অংশ নেয়। পাক সেনারা মৃতদেহটি পরে নারচীর গেরিলা দল মহিষের গাড়ী করিয়া লইয়া যাইয়া নারচীর সমুখস্থ বাঙ্গালী নদীতে ফেলিয়া দেয়। দীঘলকান্দির চান্দ কশাই ও চরকাধিকার একজন গ্রামবাসী পাক বাহিনীর গুলিতে মৃত্যবরণ করে।

 ১৩ই ডিসেম্বর বর্বর পাক বাহিনীর সহিত মিত্রবাহিনী এবং মুক্তিবাহিনীর সহিত হিলি সীমান্তে এক তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মিত্রবাহিনীর সঙ্গে ছিল মেশিনগান, ভারী কামান, ট্যাঙ্ক এবং বিমানবিধ্বংসী কামান ও বোমা। আমাদের বাংলাদেশের কতকগুলি দামাল ছেলের সঙ্গে ছিল, সামান্য স্টেনগান এসএলআর রাইফেল, এলএমজি আর পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে ছিল কতকগুলি মানব হত্যার মারণাস্ত্র।

 এই যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হইয়াছিল আলম বাহিনী, সেলিম বাহিনী এবং এবাদ বাহিনী। প্রথম মিত্রবাহিনী পাকসৈন্যদের উপর বিমান থেকে গুলি বর্ষণ করিতে থাকে। তারপর শুরু হয় এক ঐতিহাসিক তুমুল যুদ্ধ। পৃথিবী থাকিবে, বাংলাদেশ থাকিবে, তাহার সহিত এই হিলির যুদ্ধ চিরদিন বাংলার ইতিহাসের পাতায় লিখা থাকিবে। এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনীর সাতশত সৈন্য নিহত এবং কতকগুলি অস্ত্রশস্ত্র, ট্যাঙ্ক, মেশিনগানসহ আড়াইশত পাক সৈন্য আত্মসমর্পণ করে। মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর অল্পসংখ্যক যোদ্ধা হতাহত হয়। হিলি দখল করার পর বিবরঘাঁটি থেকে তিনশত নির্যাতিত নারীকে উদ্ধার করা হয়।

 ঐদিন বগুড়ার পুলিশ লাইন হইতে অহরহ শেলবর্ষণ হইতে থাকে। শহরের এবং কলোনীর বিহারীরা ভীত সন্ত্রস্ত হইয়া যেখানে পারে নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণ করে। পাকসৈন্যরা পরাজিত মনে করিয়া তাহারা করতোয়া রেলওয়ে ব্রীজ ও ফতেআলী ব্রীজ ধ্বংস করিবার উদ্দেশ্য ডিনামাইট পুঁতিয়া রাখে। ঐদিন মিত্র বাহিনীর একশত সাতাশটি ভারতীয় ট্যাঙ্ক ত্রিমুখী সাঁড়াশী আক্রমণ করিবার জন্য গাবতলী হইয়া মাদলার পথে এবং মহাস্থান ও দুপচাচিয়া হইয়া বগুড়া শহরের উপকণ্ঠে আসিয়া পৌঁছে। তুমুল ট্যাঙ্ক যুদ্ধ ও বোমা বিস্ফোরণে সমস্ত শহর প্রকম্পিত হয় এবং আগুনের লেলিহান শিখা দৃষ্ট হইতে থাকে। দুই একটি বোমার আঘাতে পার্শ্ববর্তী গ্রামের কিছুসংখ্যক লোক হত ও বাড়ীঘর বিধ্বস্ত হয়।

 ১৪ই ডিসেম্বর বগুড়া শহর হইতে পলাতক দুইজন পাকসৈন্য সদর থানার সাবরুল ইস্কুলের মাঠ দিয়া পালাইয়া যাইতেছিল। ঐ সময় গেরিলা বাহিনীর আনোয়ার হোসেন, রফিক ও আরও অনেকে এবং গ্রামবাসী লাঠিসোটা এবং বর্শা প্রভৃতি লইয়া তাহাদিগকে আক্রমণ করে। তাহাদিগকে ধরিয়া মারপিট করিয়া হত্যা করে।

 ১৫ই ডিসেম্বর পলাতক পাকবাহিনী ও কিছু অবাঙ্গালী বগুড়া শহর হইতে পালাইয়া যাইবার সময় গোলাগুলি বর্ষণ করিতে থাকে। তাহারা শহর হইতে একটি লরী লইয়া যাইতেছিল। লরীটি বিকল হইয়া গেলে তাহারা মার্চ করিতে পদব্রজে অগ্রসর হইতে থাকে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন গ্রাম হইতে মুক্তিবাহিনীর দল আসিয়া পাল্টা গুলিবর্ষণ করিতে থাকে। ফলে মুক্তিবাহিনীর একজন শহীদ ও দুইজন আহত হয়। জানা যায়। ঘটনার কয়েকদিন পূর্বে পাকসৈন্যরা ডেমাজানী আসিয়া আকস্মিক গুলিবর্ষণ করিতে থাকে। ফলে কমলরাজভর নামে একজন নিহত