সেনাবাহিনীকে। আর চূড়ান্ত আঘাত হানার সেটাই সুবর্ণ সুযোগ। একদিকে যেমন চলছিলো এসব পরিকল্পনা, অন্যদিকে সময়ের সাথে সাথে ভারত ও পাকিস্তান ক্রমান্বয়ে এগিয়ে চলছিলো একটা অবশ্যম্ভাবী যুদ্ধের দিকে।
কোণঠাসা
সেপ্টেম্বর থেকেই ভারতে ব্যাপক যুদ্ধ প্রস্তুতি শুরু হয়। ডিভিশনাল এবং কোর হেডকোয়ার্টারগুলো অগ্রবর্তী স্থানসমূহে অবস্থান গ্রহণ করতে থাকে। সরবরাহ ব্যবস্থা ও রণপ্রস্তুতিতে ব্যাপক চাঞ্চল্য লক্ষ করা যায়। ভারতীয় সেনাবাহিনী সম্ভাব্য সংঘর্ষস্থল- অভিমুখী সড়ক নির্মাণ, সেতুগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের কাজ পূর্ণ উদ্যমে শুরু করে। কতগুলো ইউনিট সীমান্তবর্তী ঘাঁটিসমূহে অবস্থান নেয়। ভূ-প্রকৃতি এবং সম্ভাব্য রণাঙ্গনের অবস্থা বিশ্লেষণসহ ব্যাপক পর্যবেক্ষণ তৎপরতা চলতে থাকে।
এদিকে আমরা প্রতিদিন ট্রেনিংপ্রাপ্ত শত শত মুক্তিযোদ্ধাকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠাচ্ছিলাম বটে, কিন্তু তেমন কোন উল্লেখযোগ্য ফল পাচ্ছিলাম না। সকল স্তরে নেতৃত্বদানের অভাবই ছিল আমাদের প্রধান অন্তরায়। কোন স্থানেই আমদের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ স্থাপিত হচ্ছিলো না এবং গেরিলা তৎপরতা আশানুরূপ জোরদার করার ক্ষেত্রেও পেছনে পড়ে যাচ্ছিলাম। এ সময়ে বাংলাদেশে নেতৃত্বেও শূণ্যতা পূরণের জন্য, বিশেষ করে গেরিলা ঘাঁটিগুলোর জন্য কিছুসংখ্যক এম-সি-এ (গণপরিষদ সদস্য) কে ট্রেনিং দেওয়ার একটা উদ্যোগ নেয়া হয়। উপস্থিত এম-সি-এ দের যারা উৎসাহী এবং শারীরিক দিক থেকে সমর্থ- তাঁদেরকে গেরিলা যুদ্ধের কায়দা-কানুন, বিশেষতঃ গেরিলাদের নিয়ন্ত্রণ ও নেতৃত্বদানের বিষয়ে ট্রেনিং প্রদানই এই প্রচেষ্টর লক্ষ্য। কথা ছিল ট্রেনিংয়ের পর তারা বাংলাদেশে যার যার এলাকায় গিয়ে গেরিলা তৎপরতা পরিবচালনা করবেন। আমার সেক্টরে এম-সি-এ জনাব মোশাররফ হোসেন এবং আরো কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা এ ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ গ্রহন করেন। গেরিলাদের নেতৃত্বদানের জন্য তাঁদেরকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠানো হয়েছিলো। অন্যান্য সেক্টরের কয়েকজন এম-সি-এ কে পাঠানো হয়। কিন্তু সারা দেশে এ কাজের জন্য প্রেরিত এম-সি-এ দের সংখ্যা ছিল নিতান্তই নগণ্য। অল্প কয়েকজন এস-সি-এ ট্রেনিং গ্রহণ করেছিলেন, যুদ্ধ করতে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিলেন তার চাইতেও কম। ফলে পরিকল্পনাটি তেমন কোন কাজে আসেনি।
সমগ্র উপমহাদেশ জুড়ে একদিকে যখন ব্যাপকতর যুদ্ধ আসন্ন হয়ে আসছিলো তখন অন্যদিকে সামরিক আরো জোরদার করার জন্য আমাদের অর্থাৎ সেক্টর কামণ্ডারদের ওপরও চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছিলো। বলা হচ্ছিল শত্রুকে আগে ছত্রভঙ্গ করে ও দুর্বল করে রাখতে হবে। তাহলে সহজেই চূড়ান্ত অভিযান চালিয়ে তাদের পরাভূত করা সম্ভব হবে এবং এই লক্ষ্য অর্জন করতে হবে যথাসাধ্য স্বল্প সময়ের মধ্যে, সম্ভব হলে নভেম্বরের মধ্যেই।
অথচ অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য দিক দিয়ে আমাদের যা সামর্থ তাতে করে এই সীমিত সময়ের মধ্যে আরদ্ধ দায়িত্ব পালন করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব। আমার ১ নম্বর সেক্টরের আওতায় ছিলো মহুরী নদীর সমগ্র পূর্বাঞ্চল, অর্থাৎ পুরো চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা। এখানে শত্রুপক্ষের শক্তি ছিলো দুই ব্রিগেডের বেশী। এ ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত আরো দু'টি আধা-সামরিক ব্যাটালিয়ন এই অঞ্চলে শত্রুপক্ষের শক্তিবৃদ্ধি করছিলো। আমাদের পক্ষে ছিলো ইপিআর, পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর লোক নিয়ে তিনটি ব্যাটালিয়ন। সমগ্র সেক্টরে অফিসার পেয়েছিলাম সেনাবাহিনীর চারজন এবং বিমান বাহিনীর দু'জন। পাক সোনাবাহিনীর পক্ষে এখানে অফিসারের সংখ্যা ছিলো অন্যূন ১৫০। ১ নম্বর সেক্টরে সাব-সেক্টর করেছিলাম পাঁচটি। এর প্রতিটির কমাণ্ডে ছিলো একজন অফিসার কিংবা একজন জেসিও। কমাণ্ড সংক্রান্ত জটিল সমস্যাবলীর ব্যাপারে এঁদের অভিজ্ঞতা ছিলো নিতান্তই সামান্য। আর আমার এলাকায় সক্রিয় যুদ্ধ চলছিলো অর্ধশতাধিক মাইলেরও অধিক সীমান্ত এলাকা জুড়ে।