পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
15

 সেক্টর হেডকোয়ার্টারেই সমস্যার চাপ ছিলো সবচাইতে বেশী। আমার একজন মাত্র স্টাফ অফিসারকে সকল প্রাশাসনিক এবং সরবরাহ ব্যাবস্থা দেখতে হতো। কাজের মেয়াদ ছিলো দিনরাত ২৪ ঘণ্টা এবং সপ্তাহে সাত দিন। কাজের অসহ্য চাপে আমার স্টাফ অফিসার শেষ পর্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়ে। কিন্তু হাসপাতালে কয়েকদিন থাকার পর আবার তাকে কাজ শুরু করতে হয়। এই অবস্থার কোন বিকল্প খুঁজে পাচ্ছিলাম না।

 আমাদের সরবরাহ ঘাঁটি ছিলো আগরতলায়। তিন হাজার লোকের জন্য রেশন, জ্বালানী, তাঁবু ও অন্যান্য সরঞ্জাম, কাপড়-চোপড়, অস্ত্রশস্ত্র, ঔষধপত্র সবকিছু সেখান থেকে নিয়ে আসতে হতো। সেই একই গাড়িতে করে দুর্গম পার্বত্য অঞ্চল পাড়ি দিয়ে এগুলো আবার বিভিন্ন সাব-সেক্টরে পৌঁছানো হতো। বৃষ্টি- বাদলের দিনে সরবরাহ ব্যাবস্থা চালু রাখতে আমাদের জীবন ওষ্ঠাগত হয়ে উঠেছিলো। কোন কোন সময় গাড়ি রাস্তার বাইরে গড়িয়ে পড়লে কিংবা হাঁটু সমান কাঁদায় ঢাকা বসে গেলে সেই গাড়ি না তোলা পর্যন্ত কিংবা রসদপত্র মাথায় করে গন্তব্যস্থলে না পৌঁছানো পর্যন্ত সেখানে একজন অফিসারকে অপেক্ষা করতে হতো।

 গেরিলা বাহিনীর প্রাশাসনিক এবং অভিযান নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত দায়িত্ব ছিলো আরো কষ্টকর। বাংলাদেশের অভ্যান্তরে নিযুক্ত লাভের আশায় শত শত গেলিলা প্রতিদিন আমার হেডকোয়ার্টারে আসতো। তাদেরকে এলাকা ভিত্তিক গ্রুপে ভাগ করতে হতো, তারপর আসতো দায়িত্ব সম্পর্কে তাদেও ব্রিফিং-এর পালা। প্রতিটি গ্রুপকে ব্রিপিং করতে কম করে হলেও এক ঘণ্টা সময় লাগতো। বিশেষ কাজের জন্য ব্রিফিং-এ সময় লাগতো আরো বেশী। প্রত্যেক গ্রুপকেই অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, এবং রাহা খরচ দিতে হতো। ছেলেদের নিরাপদে ভেতরে পাঠানোর জন্য শত্রু বাহিনীর তৎপরতা ও চলাচল সংক্রান্ত সর্বশেষ খবর সংগ্রহ করতে হতো। টহলদার শত্রুসেনারা এক জায়গায় থাকতো না বলে সর্বশেষ খবরেরও পরিবর্তন ঘটতো। এদের কাছে গাইড থাকতো। তারা নিরাপদ রাস্তা ধরে নিকটবর্তী ঘাঁটিতে নিকটবর্তী ঘাঁটিতে (সাধারনতঃ সীমান্তরেখা থেকে ৮-১০ মাইলের মধ্যে) গেরিলাদের পৌঁছে দিতো। নতুন আগন্তুকদের সম্পর্কে ঘাঁটিতে আগেই খবর দেয়া থাকতো। সেখানে তাদের খাদ্য ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা হতো। একই পদ্ধতিতে সেখান থেকে তাদের রওয়ানা হতে হতো পরবর্তী ঘাঁটিতে। তাদেরকে অতি সাবধানে আক্রমণ স্থলের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য যানবাহনের দরকার হতো। প্রত্যেক গ্রুপ সদস্যদের নাম-ঠিকানা, তাদের পরিকল্পিত পথ, ঘাঁটি, অস্ত্রশস্ত্র, গোলা-বারুদের হিসাব, কাপড়-চোপড়, রেশন, পথ খরচের টাকা-পয়সা সব কিছুর বিস্তারিত রেকর্ড রাখতে হতো। দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করার পর প্রতিটি গ্রুপের সাথে আমাদের যোগাযোগ রাখতে হতো। তাদের উপর নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করা এবং নির্ধারিত দায়িত্ব পালন নিশ্চিত করার ব্যাপারেও আমাদের তৎপর থাকতে হয়। গ্রুপগুলো নিরাপদে গন্তব্য স্থলে পৌঁছে যাওয়ার পর আমাদের তারা সে খবর জানিয়ে দিতো। তারা কোন অভিযান চালালে কিংবা শত্রুপক্ষের কোন তথ্য সংগ্রহ করতে পারেলে তাও আমাদের জানাতে হতো। আমাদের সেক্টরের ভিন্ন জায়গায় তিনটি গোপন অয়্যাসলেস সেট চালু ছিলো। এগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে আমরা নিয়মিত খবর সংগ্রহ করতাম। এছাড়া খবর সংগ্রহ করে এক বিরাট নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিলাম। বিভিন্ন দলের কাছ থেকে খবর নিয়ে এরা সেক্টর হেডকোয়ার্টারে পৌঁছে দিতো। ফেরার পথে আবার তারা বিভিন্ন দলের গাইড হিসেবে কাজ করতে। এইভাবে তাদের আবর্তনমূলক কাজ চলতো দিনের পর দিন। চর্তুদিকে সবকিছু সবসময় চালু রাখাই ছিলো আমাদের প্রধান দায়িত্ব। এর কোন একটা থামলেই বিপদের সম্ভাবনা।

 স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে জড়িত সকল শ্রেণীর লোকেরই তখন সঙ্গীন অবস্থা। মন্ত্রীসভার সদস্যবৃন্দ, আর্মি হেডকোয়ার্টারের নেতৃবৃন্দ, কিংবা ফ্রণ্ট লাইনে সংগ্রামরত যোদ্ধ সকলেরই অবস্থা অভিন্ন। যুদ্ধরত সৈনিক ও গেরিলাদের ওপর নির্দেশ আসতে থাকে যুদ্ধ আরো জোরদার করার। মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুকে অনবরত আঘাত হেনে চলেছিলো। তাদের হাতে বিপুলসংখ্যক শত্রু নিহত কিংবা আহতও হয়েছে। নিজেরাও হতাহত হয়েছে। কিন্তু কোনদিন এর স্বীকৃতি কিংবা প্রশংসা তারা খুব বিশেষ পায়নি। এ কারণে স্বভাবতই তারা ছিলো ক্ষুব্ধ।

 পার্বত্য চট্টগ্রামের একেবারে উত্তর প্রান্তে ডেমাগিরিতে কয়েক শত ছেলে ট্রেনিং নেয়ার জন্য মাসের পর মাস অপেক্ষা করেছে। তাদের মধ্যে কয়েকজন জ্বরে এবং রক্ত আমাশয়েও মারা গেছে। অন্যদেরকে দিনের পর দিন,