তারিখে ১০/১৫ জন পাকসেনা তার গরুরগাড়ী করে রেশন নিয়ে মানিকনগরে যাবে নাটোদা থেকে। ভাদুমণ্ডল বলে পাঠায় তার গাড়োয়ান যেন না মরে। আমি ১৫ জন নিয়ে একজন সিভিল গাইডের সহায়তায় অগ্রসর হয়ে বাগুয়ান এবং রতনপুর ঘাটের নিকটে এ্যামবুশ করে বসে থাকি। গাইডও আমাদের সাথে ছিল। ভোর ৬টায় আমরা রেশন নিয়ে যাওয়া পার্টির উপর আক্রমণ করি। যুদ্ধ ১ ঘণ্টা স্থায়ী হয়। মানিকনগরে ও নাটোদা হাইস্কুলে পাকবাহিনীর ঘাঁটি ছিল। গোলাগুলির শব্দে দুইদিক থেকে পাকবাহিনীর দুটি পার্টি এসে আমাকে ঘিরে ফেলে। মানিকনগরে অবস্থিত পাকবাহিনীর উপর অপর দল আক্রমণ চালিয়ে পাকবাহিনীকে ব্যস্ত রাখে। আমাদেরকে হ্যাণ্ডস-আপ করতে বলে। আমি বলি, ক্ষমতা থাকে তো এসে ধর। সামনাসামনি গোলাগালি চলছে, ফায়ার করছি আর পিছু হাটছি। আমাদের গাইড পিছনে পড়ে যায় এবং তাকে ধরে ফেলে। ঐ দিন বিকেলে ঐ অঞ্চলের সব লোকজন ডেকে নাটোদা স্কুলে দুহাত বেঁধে সবার সামনে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাকে অত্যন্ত নৃশংসভাবে হত্যা করে। পাকবাহিনীরা ঘোষণা করে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করলে এমনিভাবে শাস্তি দেওয়া হবে। আমরা সবাই মূল ঘাঁটিতে আসতে সমর্থ হই।
২০শে জুলাই থেকে ৩০শে জুলাই পর্যন্ত আমি দল নিয়ে মানিকনগরে পাকবাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণ করি। রাতে এই অপারেশনগুলোতে বেসামরিক লোক যারা ছিল তাদের সাহসিকতায় আমি ও আমার অফিসাররা চমকিত হয়েছিলাম। দিনের বেলায় মেহেরপুরে ঢুকে বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুর উপর সার্থক অপারেশন চালিয়ে তারা ভরানদী সাঁতরে ফিরে এসেছে, পাক আর্মির বাঙ্কারে ঢুকে বিভিন্ন গ্রেনেড ছুঁড়ছে। এদের ত্যাগ- সাহসিকতা মনে রাখার মতো। লোকগুলো ছিলঃ (১) মোঃ সারি (২) রবীমণ্ডল, (৩) মফিজ উদ্দিন (৪) রওশন আলী (৫) বরকত আলী (৬) জামান আলী (৭) নায়েক আলী। আরও অনেকের নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। একেক রাতে ৩/৪ বার করে অপারেশন করেছি। এই কয়েকদিনের অপারেশনে ৭০ পাকসেনা খতম হয়।
৩রা আগস্ট তারিখে পাকসেনারা মানিকগঞ্জ ঘাঁটি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। পাকসেনারা মোনাখালী ঘাটে এসে আবার ঘাঁটি গাড়ে। আমরা মানিকগঞ্জ ঘাঁটি দখল করি। বহু মাইন ও অন্যান্য গোলাবারুদ উদ্ধার করি।
১৩রা আগস্ট তারিখে পাকবাহিনীর একটি দল তাদের প্রতিরক্ষা মজবুত করা এবং গ্রেনেডের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কাঁটাতার নিয়ে যাচ্ছিল। আমি আমার পার্টি নিয়ে আক্রমণ করে বেশ কিছু হতাহত করি।
২৪শে আগস্ট তারিখে পাকবাহিনীর একটি কোম্পানী নাটোদা থেকে মুজিবনগরের পথে অগ্রসর হয়। আমি একটি পার্টি নিয়ে বাওয়ানে এবং অপরটি মানিকনগরে। সকাল দশটার সময় ওরা আমাদের আওতায় চলে আসে। আমরা ফায়ার ওপেন করি। যুদ্ধ প্রায় আড়াই ঘণ্টা হয় পাকসেনারা ৯ জন নিহত ও বেশ কিছু আহত হয়ে পিছু হটে। আমাদের একজন এলএমজি ম্যান আহত হয়। যুদ্ধ চলা অবস্থায় ওখানকার ছোট ছোট ছেলেরা গোলাবারুদ মাথায় করে আমাদের সাপ্লাই দিত। অঞ্জলি নামে একজন খৃষ্টান নার্স সব সময় আমাদের সেবা শুশ্রুষা করতো। সে আগে গ্রাম রেকি করে আমাদের খবর দিত। সব সময় প্রথম সারিতে থাকতো।
এরপর ৯নং সেক্টরকে সাহায্য করার জন্য ক্যাপ্টেন এ আর আযম চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি কোম্পানী নিয়ে সেপ্টেম্বর মাসে খুলনা যাই। ওখানে ৮/১০ দিন বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নেই। সেপ্টেম্বর মাসেই আমি মুজিব নগরে ফিরে আসি। তারপর ৩রা নভেম্বর মানিকনগর, ৬ই নভেম্বর রশিপুর ঘাট, ১২ নভেম্বর মোনাখালী ঘাট, ১৮ই নভেম্বর রশিপুর ঘাটে, ১৯শে নভেম্বর মানিকনগর ঘাটে, ২৬শে নভেম্বর রশিপুর ঘাট, ৩০ নভেম্বর রাজাপুর ঘাট, ১লা ডিসেম্বর রাজাপুর, ৩রা ডিসেম্বর রাজাপুর প্রভৃতি স্থানে আমার নিজের কমাণ্ডে যুদ্ধ করেছি। তারপর যৌথ অপারেশনে অংশ নেই।