পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪০৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
383

আসতে হবে। সংবাদটা শুনে খুবই উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। এই সুযোগে সুন্দরবন, বঙ্গোপসাগর হয়ে ভারত থেকে অস্ত্র নিয়ে আসা সম্ভব হবে। এই দুর্যোগময় মুহূর্তেও আমার ছোট্ট মনটি অপার উৎসাহে চোখ ফাঁকি দিয়ে অস্ত্র নিয়ে আসবো। লেফটেন্যাণ্ট মেহেদী, লেঃ জিয়া এবং লেঃ নাসেরকে যথাক্রমে পটুয়াখালী, বরিশাল ও খুলনায় যুদ্ধ চালিয়ে যাবার নির্দেশ দিয়ে ক্যাপ্টেন হুদাকে সাথে নিয়ে ভারত রওনা হলাম।

গুপ্ত পথে যাত্রা

 সুন্দরবন বাংলাদেশের বিখ্যাত অরণ্যানি। এই সুন্দরবনের গোপন পথ ধরেই আমার ভারত যাত্রা শুরু হলো। রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিতাবাঘ, হরিণ ও অজগরে সুন্দরবন ভরপুর। জানা-অজানা অনেক শংকা ও বিপদের ঝুঁকি দিয়ে ছোট একটি লঞ্চ, পথের জন্য সপ্তাহের কিছু রেশন ও অন্যান্য জিনিসপত্র আমরা যাত্রা শুরু করলাম। সবাই মিলে লঞ্চে আমরা বিশজন নাবিক ছিলাম। এদের মধ্যে দু'জন প্রকৃত যুদ্ধ করার মত। পনের থেকে বিশের মধ্যে এদের বয়স। আগে সেনাবাহিনীতে ছিল। নাম সিদ্দিক ও জববার। আমাদের বলা হয়েছিল সুন্দরবনের চারপাশে পাকিস্তানী হানাদাররা 'গানবোট' নিয়ে পাহারা দিচ্ছে। আর বাংলাদেশের নিরীহ গ্রামবাসীদের উপর বর্বরের মতো নির্বিচারে গোলাবর্ষণ করে ভয়ানক সন্ত্রাসের সৃষ্টি করছে। সন্ধ্যার দিকে অনেক দূরে ‘পশুর’ ও শিক্সা' নদীর মোহনায় হঠাৎ করে একটা গানবোট চোখে পড়লো। এই বিরাট নদী দুটো অতিক্রম করে আমাদের নিরাপদ জায়গায় যেতে হবে। সামনেই দিগন্তবিস্তৃত বঙ্গোপসাগর। ‘পশুর ও শিল্পা’ এই বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে। অন্ধকারে বিশাল জলরাশির দৃশ্য ভয়ংকর ও ভীতিপ্রদ। একটা প্রেতপুরীর মতো। দলের অধিনায়ক হিসেবে আসন্ন বিপদের ভয়কে চেপে গিয়ে আত্মবিশ্বাসকে ঘা দিয়ে চাংগা করে তুললাম। আমাদের লঞ্চের প্রধান পাইলট কিছুদিন আগেও একজন কুখ্যাত চোরাচালানী ছিল। জংগলের সব গোপন রাস্তা তার নখদর্পণে। তাকে বললাম যদি কোন বিকল্প পথ থেকে থাকে তাহলে লঞ্চের গতি সেই দিকেই ঘোরাতে। সে আমার আদেশ মানলো। আমি আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলাম। পরদিন ভারতের সীমান্তবর্তী চৌকি ‘পারগোমতী' এসে পৌঁছলাম। ভারতের সীমান্তরক্ষীরা আগেই আমাদের আসার খবর পেয়েছিল। তারা আমাদের আসার বৈধতা পরীক্ষা করে সামনে এগুবার অনুমতি দিল।

 ২৪শে এপ্রিল ভোরে 'পারগোমতি'র একটা জায়গায় ভারতীয় সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর ইন্সপেক্টর মিঃ পি কে ঘোষ আমাদেরকে বিদায় সম্ভাষণ জানালেন এবং অগ্রবর্তী ঘাঁটিতে যোগাযোগের পর ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সতর্ক পাহারায় ক্যাপ্টেন হুদা ও আমাকে সামনে এগুবার অনুমতি দিলেন। এই সময় আমরা ‘হিংগুলগঞ্জ' নামক অপর একটি ভারতীয় সীমান্ত চৌকির দিকে অগ্রসর হচ্ছিলাম। সিদ্দিকসহ লঞ্চের অন্যান্য সাথীদের লঞ্চসহ এখানেই ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর তত্ত্বাবধানে রেখে গেলাম।

 নিরাপদ স্থানে পৌঁছার জন্য ভারতের সীমান্ত ধরে আমরা এগুতে লাগলাম। কারণ, নদীর ওপারেই পাকিস্তানী হানাদাররা ওঁৎ পেতে বসেছিল। ওপারের দূরত্ব এক হাজার গজের বেশী নয়। বর্বর পাকিস্তানী হানাদারদের মেশিনগানগুলো যে কোন সময় গর্জে উঠতে পারে। এই ভয়ে আমরা সতর্ক ও সচেতন ছিলাম। দেখতে পেলাম ওপারে পাকিস্তানী সৈন্যরা ট্রিগারে হাত দিয়ে আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। নদীর ঢেউগুলো স্পীডবোটের কাঠের দেহটাকে হাপরের মতে পিটাচ্ছিল। ভয় হলো ওর দেহটা না টুকরো টুকরো হয়ে যায়।

 ঢেউয়ের বুক চিরে ক্ষুদে দৈত্যের মতো স্পীডবোটটা আমাদের নিয়ে দ্রুতগতিতে ছুটে চললো গন্তব্যস্থানের দিকে। মুখ ঘুরাতেই সামনে দেখতে পেলাম নদীর তীর বরাবর ভারতীয় সীমান্তে বেশ বড় বড় কতকগুলো বাড়ি। উপর দিকটা লাল, এমন কতকগুলো সেনানিবাস এই বাড়িগুলো চারদিক দিয়ে ঘিরে রেখেছে। বহু আকাংক্ষিত স্থানে নিরাপদে পৌঁছাতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম। নতুন করে ইস্পাত কঠিন সংকল্প ও শক্তি সঞ্চয়