পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
17

 যথারীতি পরিল্পনাটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত গ্রহীত হলে এ কাজের জন্য আমি আমার সাথে কার্যরত বিমান বাহিনীর নির্ভীক অফিসার ফ্লাইট লেফটেন্যাণ্ট সুলতানকে মনোনীত করলাম। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তাকে আমি পরিকল্পনাটি বুঝিয়ে দিলাম এবং তার রেইডিং পার্টির সদস্যদেররক বেছে নিতে বললাম। এরপর সবাই মিলে আমরা কয়েকটি মহড়া দিলাম। ‘রেইডিং' পার্টির সদস্যদেরকে কি কাজে কোথায় পাঠানো হচ্ছে সেকথা আগে বলা হতো না। একবারে সর্বশেষ ঘাঁটিতে পৌঁছার পর যখন তারা লক্ষ্যবস্তুর উপর আঘাত হানতে যাবে তখনই তাদেরকে বলা হবে, তার আগে নয়। সুলতান তাঁর দলের লোক এবং প্রযোজনীয় অস্ত্রশস্ত্র বেছে নিলো। বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ধ্বংস করা ছাড়াও সুলতানের ওপর ঐ এলাকায় গেরিলা তৎপরতা হ্রাস পাওয়ার কারণ নির্ণয়ের দায়িত্ব দেয়া হলো।

 ১১ই সেপ্টেম্বর সুলতানের সঙ্গে কয়েকজন বিশেষ ট্রেনিংপ্রাপ্ত এবং কিছুসংখ্যক নিয়মিত সৈন্যকে হরিণা থেকে এ অভিযানে পাঠানো হলো।

 ৩রা অক্টোবর তার পার্টি দুঃসাহসী অভিযান চালিয়ে শহর থেকে মাত্র মাইলখানেক দূরেই মদনাঘাটের বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার ধ্বংস করে দিলো। বহুসংখ্যক বৈদ্যুতিক পাইলনও উড়িয়ে দেওয়া হয়। এতে কাপ্তাই থেকে সরবরাহ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে পড়ে। বিশেষভাবে সুরক্ষিত মদনাঘাট বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির চারদিকে ছিলো ইঁটের দেয়াল আর দুর্ভেদ্য কাঁটাতারের বেড়া। এখানে মোতায়েন থাকতো ১০জন নিয়মিত সৈন্য এবং ২০ জন আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্যের একটি প্লাটুন। তারা সব সময় চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখছিলো। তার মধ্যে থেকে সুলতান তাঁর দল নিয়ে শত্রুর উপর সফলতার সাথে এই আক্রমণ সম্পন্ন করে। আগস্ট মাসের মাঝামাঝিতে বন্দরের জাহাজ ধ্বংসের পর আবার দুঃসাহসী হামলায় শত্রুরা দিশেহারা হয়ে পড়ে। তারা বুঝতে পারলো যে গেরিলারা ক্রমান্বয়ে অধিকতর শক্তিশালী হয়ে উঠছে।

 অভিযান শেষ করে ফ্লাইট লেফটেন্যাণ্ট সুলতান ঐ এলাকার অধিকাংশ গেরিলা গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তাদের অসুবিধা এবং সমস্যাবলী নিয়েও আলোচনা হয়। ১১ই অক্টোবর হরিণায় ফিরে এসে সুলতান বিস্তারিত রিপোর্ট পেশ করেন।

 গেরিলারা গ্রামাঞ্চলে বেশ কার্যকর অবস্থান গড়ে তুলছিলো। বস্তুতঃ সারা দেশটাই তখন বিরাট এক গেরিলা ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছিলো। ফলে যখন তখন ছেলেরা যেকোন দিকে অভিযান চালাতে পারতো। রাতগুলো ছিলো একান্তভাবেই তাদের। ফলে পাকিস্তানী সৈন্যরা রাতের বেলায় পারতপক্ষে বাইরে বের হতো না।

 আমাদের পক্ষে জনগনের সমর্থন ছিলো ব্যাপক। গেরিলাদের সাহায্যে আসতে পারলে লোকজন সম্মানিত এবং গর্ব অনুভব করতো। গেরিলাদের খাদ্য ও আশ্রয় দেয়ার অপরাধে পাকিস্তানীরা বহু লোককে হত্যা করেছে, তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে, সহায়-সম্পত্তি লুট করে সেই লুটের মালের বখরা পুরস্কার হিসাবে রাজাকার ও দালালদের দেয়া হয়েছে। এতদসত্ত্বেও জনগণের হৃদয় আবেগ এবং উচ্ছ্বাসের উদ্বেলিত হয়ে উঠেছে, যখন দেখেছে অল্প বয়সী তরুণেরা ভারী অস্ত্র-গোলাবারুদের ভারে ন্যুব্জ হয়েও দৃঢ়প্রত্যয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে শত্রুহননে এগিয়ে চলেছে। বাংলার জনগণ মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাগত জানানোর জন্য সাগ্রহে প্রতীক্ষা করেছে দিনের পর দিন। দেশের ভেতরে অবস্থানকারী লোকজন যদি সেদিন এই ত্যাগ স্বীকার না করতো তাহলে অঙ্কুরেই আমাদের স্বাধীনত আন্দোলনের স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটতো।

যুদ্ধের মুখোমুখি

 আমরা সিদ্ধান্ত নেই, রণকৌশলের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা এবং যেসব সীমান্ত ফাঁড়িতে শত্রুর প্রহরা একটু কম, সেগুলো দখলের মাধ্যমেই আমাদের অভিযান শুরু হবে। প্রতিটি অভিযান শুরুর পূর্বেই ভারতীয়