বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪২৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দশম খণ্ড
398

রেখেছিল। ভাবতে অবাক লাগে, মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়ার চাইতে যুদ্ধের দিকে আসক্তি ছিল বেশী। শত্রুর উপর হামলা করার জন্য ক্যাপ্টেন হুদা ও সহ-অধিনায়ক বেগ দুশো মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে একদিন রাতে শ্যামনগরের দিকে অগ্রসর হলো। সময়টা এমনভাবে নির্ধারিত করা হয়েছিল যে রাত্রে রওনা হয়ে ভোর হওয়ার কিছু আগেই শ্যমনগর পৌঁছে যায় যাতে করে মুক্তিযোদ্ধাদের ছোট ছোট দলে ভাগ করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বসিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট সময় হাতে পাওয়া যায়।

 ছোট ছোট ছেলেদের পক্ষে ধানক্ষেতের মধ্য এই দীর্ঘ পথ হেঁটে যাওয়া খুব আরামদায়ক ছিল না। নিচে পায়ে কাঁটার আঘাত, উপরে ঠাণ্ডা বাতাস আর বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ওরা অন্ধকারের ভেতর এগিয়ে চললো শ্যামনগরের দিকে। পথের সাময়িক বাধাকে ওরা ভ্রক্ষেপই করলো না। কেননা ওদের অন্তরে ছিল বাংলার সোনালী ভবিষ্যৎ আর শত্রুর প্রতি হিংসার চরম আগুন। সারাদিন তীব্র সংঘর্ষের পর সন্ধ্যা নামতেই শত্রুপক্ষের কামান, মর্টার, মেশিনগান স্তব্ধ হয়ে গেল এবং হানাদাররা চরম পরাজয় বরণ করলো। যুদ্ধক্ষেত্রের কিছু পেছনে শত্রুপক্ষের পঞ্চাশজনের একটা দল বেতারযন্ত্র ও ভারি অস্ত্রপাতি নিয়ে আবস্থান করছিল। ওদের মর্টার ও কামানের গুলি শ্যামল-শস্যক্ষেত পুড়িয়ে ছারখার করে দিল। কিন্তু আমাদের বিশেষ ক্ষতি করতে পারলো না। শত্রুপক্ষের লোকজন পালিয়ে যাবার সময় পথে গোপন স্থানে লুকিয়ে থাকা আমাদের ছেলেরা অতর্কিত ওদের উপর হামলা চালিয়ে খতম করে দেয়।

 শ্যামনগর থেকে পালাবার দুটো মাত্র পথ খোলা ছিল। একটা ভেটখালির দিকে, অন্যটা বসন্তপুরের দিকে। এই দুটো রাস্তাতেই হাবিলদার সোবহান ও মুক্তিযোদ্ধা লিয়াকতের অধীনে আমাদের ছেলেরা ওঁৎ পেতে বসে ছিল। লিয়াকত দুর্দান্ত সাহসী। নবেম্বর মাসের কোন সময়ে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীতে অফিসার পদের প্রশিক্ষণের জন্য চলে যায়। শ্যামনগরের উপরে এই আক্রমণ আমার সেক্টরে একটা বিরাট বিজয়। এই বিজয়ে জনসাধারণেরও মনোবল অনেকাংশে বেড়ে গেল। শত্রুপক্ষের ক্ষতির তুলনায় আমাদের তেমন বিশেষ ক্ষতি হয়নি। ওদের অনেক লোকজন মারা যায়। আমাদের চারটি ছেলের মধ্যে মারাত্মকভাবে দু'জন জখম হয়। আর দু'জন সামান্য আঘাত পায়।

 শ্যামনগর মুক্ত হওয়ায় জনগণের চক্ষু খুলে গেল। ওরা এই প্রথমবারে মত মুক্তিবাহিনীর শক্তির পরিচয় পেল। হুদার কাছে খবর পাঠালাম, যেভাবেই হোক একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত শ্যামনগর আমাদের দখলে রাখতেই হবে। কেননা, আমার ইচ্ছা দখলত্রুত রাস্তা ধরে খুলনা, মংলা ও চালনা পোর্টে মুক্তিবাহিনী পাঠিয়ে দিয়ে শত্রুর উপর আঘাত হানবো। আমার নির্দেশমত হুদা ও বেগের উপর শ্যামনগরের সমস্ত দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে কালিগঞ্জ-বসন্তপুর অঞ্চলে শত্রুপক্ষের উপর হামলা জোরদার করার জন্য সে নিজেই হিংগলগঞ্জে ছুটে এলো।

 পদাতিক বাহিনীর দ্বারা সাহায্যপুষ্ট শত্রুপক্ষের একদল সৈন্য এই অঞ্চলে ঘাঁটি গেড়ে বসেছিল। ওরা নদীপথে ইছমতী দিয়ে যাতায়াত করতে পারতো না। কিন্তু ওদের গানবোটগুলো কালিগঞ্জ বরাবর যমুনা নদী দিয়ে দক্ষিণে পাইকগাছা পর্যন্ত পাহারা দিত। যাতায়াত ও সরবরাহ ব্যবস্থা অব্যাহত রাখার এটাই প্রধান রাস্তা। শত্রুদের সরবরাহ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করার জন্য উত্তর-পূর্বদিকে যমুনার তীর বরাবর গেরিলা ঘাঁটি স্থাপন করার জন্য ক্যাপ্টেন হুদাকে একটা পরিকল্পনা তৈরী করে দিলাম। যখন খবর পাওয়া গেল যে, পাকিস্তানী গানবোটগুলো যমুনায় পাহারা দিয়ে বেড়াচ্ছে, তখন ভারতীয় সেসাবাহিনীর একটা দল রিকয়েললেস' রাইফেল নিয়ে হিংলগঞ্জ এসে ঘাঁটি গাড়লো। এই দূরপাল্লার রাইফেল দিয়ে গানবোটগুলোকে সহজেই আঘাত করা যায়। সেন বর্মা নামে একজন অল্পবয়স্ক লেফটেন্যাণ্ট এই বাহিনীর অধিনায়ক। ভারতের প্রধান নির্বাচনী কমিশনার মিঃ সে বার্মার পুত্র। পূর্বে বরিশাল জেলার অধিবাসি ছিলেন। এ সময় ভারতীয় সৈন্যরা সরাসরী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতো না। প্রয়োজনবোধে মুক্তিযোদ্ধারা কোন সাহায্য চাইলে ভারতীয় সৈন্যরা পিছন থেকে শত্রুপক্ষের উপর গোলাবর্ষণ করতো। কিন্তু প্রতিভাদীপ্ত যুবক এই সেন বর্মাকে বাধা দেবে? সে ক্যাপ্টেন হুদার ইছামতী