পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪২৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
399

পার হয়ে হানাদারদের উপর ক্ষিপ্রগতিতে আক্রমণ চালিয়ে আবার এপারে ফিরে আসতো। ক্যাপ্টেন হুদা লেঃ সেন বর্মাকে সহযোগী হিসাবে পেয়ে খুবই খুশী হলো।

 আক্রমণ পরিচালনায় হুদার যোগ্যতার উপর সম্পুর্ণ আস্থা রেখে আমি ফ্লাইট সার্জেণ্ট সলিমুল্লাহকে নিয়ে শমসেরনগরে যুদ্ধ পরিচালনা ঘাঁটি স্থাপন করার পাকাপোক্ত সিদ্যান্ত নিলাম। সলিমুল্লাহ শক্তিশালী ও সাহসী। তখনকার পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য তাকেই উপযুক্ত মনে করলাম। হাসনাবাদে আমার যে লঞ্চটি ছিল তাকে করে ত্রিশজন মুক্তিযোদ্ধাকে সলিমুল্লাহর অধীনে শমসেনগর পাঠিয়ে দিলাম। শমসেরনগর অনেক দূরে রায়মংগল নদীর তীরে অবস্থিত। এই জায়গাটার অনেক রকমের অসুবিধা ছিল। কিন্তু আমার সার্বিক যুদ্ধ পরিচালনার জন্য স্থানটার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। প্রথমতঃ আমি চাচ্ছিলাম সমগ্র সুন্দর বনাঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করে বাংলাদেশের অভ্যান্তরে গেরিলা ঘাঁটিগুলোতে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহের জন্য একটা নিরাপদ রাস্তা। দ্বিতীয়তঃ আমি ভাবছিলাম বাংলাদেশের অভ্যান্তরে একটা আক্রমণকারী দল পাঠিয়ে বরিশাল, পটুয়াখালী ও গোপালগঞ্জে যেসব বিক্ষিপ্ত মুক্তিবাহিনী শত্রুপক্ষের উপর আক্রমণ পরিচালনা করে তাদের সাথে একটা সুষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপন করা। মুক্তিযোদ্ধাদের কোন তাঁবু, রেশন ও পোশাক না থাকা সত্ত্বেও সলিমুল্লাহ হৃষ্টচিত্তে শুধুমাত্র সাহসের উপর ভর করে আগস্ট মাসের শেষদিকে শমসেরনগরে ঘাঁটি স্থাপন করতে উঠে পড়ে লেগে গেলো। বর্ষা ঋতুতেই সে ঘাঁটি বানাবার মনস্থ করলো। শমসেরনগরে ভারতীয় সীমান্তবর্তী ফাঁড়ির আধ মাইল দক্ষিণে নদীর তীরে বাঁশ দিয়ে একটা ঘাঁটির মত তৈরী করা হলো। এর চতুর্দিকে কাদাপানি। ওকে যে কাজের ঘাঁটিটার চারদিক জলকাদা। আসলে সলিমুল্লাহ সাহেব একজন কেতাদুরস্ত লোক। বর্ষা ও কাদামাটির ভেতর যখন মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বেরিয়ে পড়তো, তখন ফ্লাইট সার্জেণ্ট সলিমুল্লাহকে খুবই খুশী মনে করত। বিশেষভাবে তাগিদ দেয়ায় তার ছেলেদের জন্য বর্ষাতি পাঠিয়ে দিলাম। সপ্তাহ শেষে প্রয়োজনীয় রেশনপত্র পাঠিয়ে দিতাম। সলিমুল্লাহর তেমন আর কোন অভিযোগ ছিল না। শুধু প্রধান লঞ্চচালক মোশাররফ মিয়া মাঝে মাঝে অস্ত্রশস্ত্রের একটা বড় তালিকা নিয়ে হাজির হতো।

 শমসেরনগর যাবার কিছুদিন পরেই কৈখালিতে পাক বাহিনীর উপর উপর্যুপরি কয়েকবার হামলা চালিয়ে সীমান্তবর্তী ঘাঁটিটা অধিকার করি এবং সরাসরি এপারে সলিমুল্লাহ আর একটা ঘাঁটি স্থাপন করে। ইতমধ্যে সুন্দরবনের ‘রাজা' নওয়াবদীর সাথে তার পরিচয় হয়। সুন্দরবন এলাকায় এই নওয়াবদী রূপকথার সেই কালো দৈত্যটার মত। বেশ বড় মুখমণ্ডল। সারামুখ ভর্তি দাড়ি। প্রায় ছ'ফুট লম্বা। দেহগঠন অত্যান্ত সুদৃঢ়। সারা সুন্দরবন এলাকায় সে একটা ভয়ানক ত্রাস। তার একমাত্র ব্যবসা চোরাচালানি। পূর্বের কুকীর্তি সত্ত্বেও, যখন আমি সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তার সাথে দেখা করলাম তখন আমার কাছে সে অত্যান্ত লাজুক, ভদ্র ও অতিথিপরায়ণ বলে মনে হলো। হ্যাঁ, মনে পড়ছে, তারিখটা ৩রা সেপ্টেম্বর।

 আমার সেক্টরের একটা লঞ্চে করে যাচ্ছিলাম। আমার অধীনস্থ লঞ্চগুলো শীগগীরই 'বাংলাদেশ নেভি' নামে পরিচিত হলো। সেপ্টেম্বরের শেষদিক আমার নৌ-বাহিনীতে ৬ টা মটর লঞ্চ যোগাড় করা হয়। এগুলো শত্রুবাহিনীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল। শুধুমাত্র যাতায়াত ব্যবস্থার জন্য নিয়োজিত রাখার চাইতে আমি ভাবলাম, এগুলোকে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করে গানবোটের কায়দায় ব্যবহার করা ভাল। সর্বধিনায়ক কর্নেল ওসমানীর কাছে আমি আমার পরিকল্পনার কথা জানাতেই তৎক্ষণাৎ রাজী হয়ে গেলেন। তারপর অধিনায়ক মুখার্জীর আন্তরিক প্রচেষ্টায় ভারতীয় বাহিনীকে অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আমার ছ'টি লঞ্চের জন্য ৫০টি ব্রাউনিং বিমানবিধ্বংসী মেশিনগান নিয়ে এলাম। হালকা মেশিনগান ও ছোট ধরনের অস্ত্রশস্ত্র চালাবার জন্য এক একটি লঞ্চে দশজন করে নাবিক মোতায়েন করলাম। আমার ভাগ্য ভাল যে, আমি সব নৌ-বাহিনীর লোকজন পেয়ে গিয়েছিলাম। আগে তারা পাকিস্তান নৌ-বাহিনীতে চাকরিরত ছিল। বদরে আলম নামে একজন বেশ অভিজ্ঞ লোকের অধীনে নৌ-বাহিনীর এইসব লোকজনকে একত্র করলাম। যুদ্ধের সময় বদরে আলমকে সম্মানসূচক লেফটেন্যাণ্ট পদে ভূষিত করা হয়। লেঃ খুরশীদ এই নৌ-বাহিনী গড়তে আমাকে সাহায্য করেছে। এইসব