পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪২৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
403

তীব্রতা বৃদ্ধি করতে পারে। কেননা, আমি জানি যে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক শক্তি সঞ্চয় ব্যতিরেকে, শুধুমাত্র সামরিক আক্রমণ পরিচালনা করেই আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবো না। রাজনৈতিক শক্তি এসে যোগ না দিলে যে কোন রকম সামরিক সফলতা, ঐক্যবদ্ধ, সমঝোতা ও সমন্বয়ের অভাবে চরম লক্ষ্যে পৌঁছা যাবে না। যা হোক, আমাদের সর্বাধিনায়ক এবং চার্লি সেক্টরের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার এন. এ. সালিক আমার পরিকল্পনাটা অনুমোদন করলেন এবং তাড়াতাড়ি এর বাস্তবায়নের জন্য নির্দেশও দিলেন।

 বিভিন্ন কেন্দ্রে গেরিলাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। আমি চারটি কেন্দ্রের খবর জানতাম। সেগুলো হলো, চাকুলিয়া ও মূর্তি বিহার প্রদেশে, একটি মেঘালয়ে ও অপরটি বীরভূম জেলায়। বিভিন্ন কেন্দ্রের ছেলেদের নিকটবর্তী প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। বাংলাদেশের সাহায্য ও পুনর্বাসন মন্ত্রী জনাব কামরুজ্জামান ভারতীয় সাহায্য ও পুর্নবাসন মন্ত্রীর সহযোগীতায় এই যুব এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো পরিচালনা করতেন। বাংলাদেশ সরকার ভারত সরকারের সাথে আলোচনা করে সাধারন নীতিমালা গ্রহন করেন যে, পঞ্চাশ হাজার লোককে গেরিলা ও বিশ হাজার লোককে নিয়মিত সামরিক ট্রেনিং দিতে হবে। জুলাই মাসে সব সেক্টর কমাণ্ডারের যে আলোচনা সভা ডাকা হয়, তাতে মিঃ তাজউদ্দীন আহমদ (তখনকার প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী) একথা প্রকাশ করেন। আমাদের কেউ কেউ গেরিলা ও সৈন্য সংখ্যা এই নির্দিষ্ট অংকে সীমাবদ্ধ রাখার কারন জিজ্ঞেস করলেন। কেননা আমরা মনে করতাম যে, নূন্যতম সংখ্যার হয়তো সীমারেখা বেঁধে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু ঊর্ধ্বতম সংখ্যার কোন সীমারেখা থাকা উচিত নয়। মনে হল এর কারন তিনি নিজেও জানতেন না। কাজেই অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে এর কারন ব্যাখ্যা করতে তিনি ব্যর্থ হলেন। ভাবতে এখনও আশ্চর্য লাগে যে, মাত্র এই দুটো বাহিনীর উপর নির্ভর করে এত তাড়াতাড়ি তিনি বিজয়ের আশা করেছিলেন কোন আশ্বাসের উপর ভর করে?

 যাহোক, এ সমস্যাটা গেরিলা যুদ্ধের অগ্রগতিকে কোনক্রমেই ব্যহত করতে পারলো না। একজন বা দ’জন ছাড়া আমার সাথে কোন অভিজ্ঞ গেরিলা নেতা ছিলনা। যে দু'একজন ছিল তারা কাজকর্ম ভালই জানতো। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলারা, যারা সময় সময় আমার ক্যাম্পে আসতো তাদের ভিতর দিয়ে দলের নেতা হবার যোগ্যতা যাদের আছে- তাদেরকেই বেছে নিতে হলো। আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী বিভিন্ন জেলার মধ্যে পারস্পরিক সমন্বয় সাধন ও যুদ্ধ পরিচালনার জন্য চারটি জেলায় চারজন সামরিক অফিসার পাঠানো প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। আগে থেকেই মুক্তিবাহিনীকে নির্দেশ দেবার জন্য খুলনা-বরিশালে ক্যাপ্টেন জিয়া এবং পটুয়াখালীতে লেঃ মেহদী ছিল। কিন্তু ফরিদপুরে কেউ না থাকায় মিঃ নুর মোহাম্মাদ নামে একজন অভিজ্ঞ নৌবাহিনীর গেরিলা শিক্ষককে সেখানে পাঠিয়ে দিলাম। চারটি জেলার জন্য চারজন সামরিক অফিসার পাওয়া যাওয়ায় তাদের নির্দেশ দিলাম সৎ লোকদের ভেতর দিয়ে কমাণ্ডার নির্বাচন করে প্রতিটি অঞ্চল ও থানায় পাঠিয়ে দিতে। পাকিস্তানী সামরিক তৎপরতার পর থেকেই যারা নিজেদের উৎসাহে ও উদ্যোগে বাংলাদেশের ভিতরে শত্রুহননের কাজে নিয়জিত আছে-তাদের সাথে যাতে করে কোন মতবিরোধ না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখার জন্য ওদের আমি প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলাম।

 জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সর্বাত্মক গেরিলা আক্রমণ চালানো হয়। আক্রমণ পরিচলনার জন্য আমি তিনটি জায়গা ঠিক করেছিলাম, পশ্চিম বঙ্গের উত্তর দিকের বনগাঁর নিকট বাগদাতে একটা হাসনাবাদের দক্ষিনে শমসের নগরে একটা এবং আর একটা টাকিতে। এই তিনটি ঘাঁটির ভিতর বাগদাই সবচেয়ে ব্যস্ততম। এর কারন মুক্তিযোদ্ধারা এই পথেই সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আসতো এবং এই দিকের পথ-ঘাট ওদের ভাল জানা ছিল। শমসেরনগর ঘাঁটি থেকে বরিশাল, পটুয়াখালী ও ভোলায় গেরিলাদের পরিচালনা ও নির্দেশ দেওয়া হতো। খুলনা জেলার গেরিলারা নদীপথে টাকির সাথে যোগাযোগ রেখে কাজ করত। শত্রুপক্ষের অবস্থানের পরিবর্তনের সাথে আক্রমনের গতিপদ্ধতিও পরিবর্তিত হত। পাঁচ মাসে, অর্থাৎ জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে সরকারী হিসাবমতে আট হাজার গেরিলা আমার সেক্টর থেকে হাল্কা অস্ত্রপাতি ও বিস্ফোরক দ্রব্যসহ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠিয়েছিলাম। শতকরা পঞ্চাশজন গেরিলাকে অস্ত্র দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। বাকী সবাই