পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪৩০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
405

নিজেকে অভিশাপ দিতাম, কেন ওদের সাথী না হয়ে অধিনায়ক হলাম। কেন ওদের পাশে থেকে যুদ্ধ করে ওদের মুখের হাসিকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলাম না। ওদের রক্তের সাগরে দাড়িয়ে মুক্তির আনন্দকে আজ বড্ড বিস্বাদ লাগলো।

 কিছুক্ষণের 'জয় বাংলা' তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব-শেখ মুজিব' এই ধ্বনিই তো ওদের অনুপ্রানিত করেছিল অনিশ্চয়তার আধার ও চরম বিপদের মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়তে। কোন পুরস্কার বা প্রতিশ্রুতির লোভে ওরা এ কাজ করেনি। দেশ ও নেতার প্রতি অপরিসীম ভালবাসা ওদের যাদুমন্ত্রে ওদের উদ্দীপ্ত করেছিল- এই মৃত্যু ভয় কে জয় করতে। আত্মোৎসর্গের কঠিন ব্রতে দীক্ষা নিয়ে বাংলার এই গেরিলারা স্বাধীনতার জন্য অবিরাম সংগ্রাম করে চলছে। বর্ষার ঔদ্ধত্যকে সংকল্পের দৃঢ়তায় ছিন্নভিন্ন করে ওরা এগিয়ে চললো। অন্ধকারের মাঝে ওদের এগিয়ে যাওয়া আমি নিরীক্ষণ করতে লাগলাম। দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পেলাম, যুদ্ধ না করেই বজ্রকঠিন শপথের আগুনে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে হানাদারদের কব্জা থেকে মুক্তির আলো একদিন এই সুর্যসন্তানেরা ছিনিয়ে আনবেই। ঘটেছিলও তাই। পাক-হানাদাররা ক্রমাগত থানা ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে যেতে লাগলো। গ্রামে যেখানেই গেরিলাদের সাথে ওদের মোকাবেলা হয়েছে, সেখানেই ওরা পুনর্বার যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এরপর হানাদাররা থানা ছেড়ে জমা হতে থাকে সামরিক ছাউনিতে এবং রাজাকারদের ওরা পুরো সুযোগ দিতে লাগলো গ্রামের উপর প্রভুত্ব চালাতে। দুর্জয় গেরিলাদের হাতে চরম মার খেয়ে রাজাকাররা তাদের রাজত্ব চালাতে চরম অসুবিধায় পড়েছিল। ওদের জঘন্য কার্যকলাপের জন্য গেরিলারা নির্মমভাবে রাজাকারদের নিশ্চিহ্ন করে দিত। আমার কাছে খবর আসলো যে, গেরিলারা পুরোদমে আক্রমণ চলিয়ে শত শত রাজাকার খতম করছে। এতে সুফল হলো-যারা একদিন রাজাকারদের বর্বরতার শিকার হয়েছিল, সেই নিঃস্ব গ্রামবাসী আবার মনোবল ফিরে পেল। বাঙালী রাজাকারদের হত্যা করাটা আমি যেন পছন্দ করতে পারলাম না- কারন, আমি জানতাম যে এই হত্যার দ্বারা শুধু অনাথ ও বিধবার সংখ্যাই বেড়ে গিয়ে দেশের সমস্যা আরো জটিল করে তুলবে। একবার আমি নির্দেশও পাঠিয়েছিলাম যে, রাজাকারদের মধ্যে মানসিক পরিবর্তন এনে অস্ত্রশস্ত্রসহ আত্মসমর্পন করতে বাধ্য করতে হবে। এই মর্মে কিছু প্রচারপত্র বিলি করা হলো। দেখা গেছে, এর ফলে অনেক রাজাকার অস্ত্রশস্ত্রসহ স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পন করেছে। গেরিলা পদ্ধতির প্রবর্তনের ফলে দুটো সুফল পাওয়া গেল। প্রথমতঃ গ্রামবাসী রাজাকার ও পাক-বর্বরদের অত্যাচারের হাত থেকে অনেকটাই রেহাই পেল। দ্বিতীয়তঃ হানাদাররা নিজেদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য গোপন আস্তানায় ঢুকে আত্মসমর্পন করতে লাগলো। তাছাড়াও রাজাকারদের ভিতর অন্তর্দ্বন্ধ, অসন্তোস ও বিভেদ সৃষ্টি করতে সফল হলাম। এর ফলে হানাদারদের পরিকল্পনায় সহজেই ফাটল ধরলো।

 আর কোন পথ খোলা না দেখে পাক-বর্বররা গানবোটের সাহয্যে আক্রমনের মাত্রা বাড়িয়ে দিল। রাজাকার ও পাকিস্তানী সৈন্যরা গানবোটে চেপে নদীর পথ ধরে চলতে থাকলো, আর মেশিনগান ও রকেট দিয়ে নির্বিচারে গোলাবর্ষণ করে নদীর তীরবর্তী গ্রামগুলো জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিতে লাগলো। পাকিস্তানী গান - বোট গুলোর এরুপ আকস্মিক হামলায় ক্ষেতখামারে কর্মরত শত-শত কৃষক, জেলে মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করলো। বাংলাদেশের নদীপথ দিয়ে গান-বোট গুলো চালিয়ে নেওয়ার সময় হানাদারেরা যাদেরই সামনে পেত- তাদের উপরই পৈশাচিক উল্লাসে মেশিন গানের গুলি ছুড়তে থাকতো। মনের অবস্থা যখন ভাল থাকতো না তখন হানাদাররা নদীর তীরে কোন গ্রামের কাছে গান-বোট ভিড়িয়ে অসভ্য তাতারের মত গ্রাম থেকে সুন্দরী যুবতী মেয়েদের ছিনিয়ে আনতো। যারা আপত্তি করতো, তাদের খতম করে দিত।

 যদিও আমাদের গেরিলারা প্রাণপণ চেষ্টা করছে এই গানবোট গুলো কাবু করার জন্য, কিন্তু ওদের কাছে নিম্নমানের অস্ত্রপাতি থাকায় গানবোটগুলোর মোকাবেলায় পেরে উঠতো না। এভাবে নৃশংস অত্যাচার চালিয়ে গানবোটগুলো গ্রামের লোকদের ভিতরে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করলো। গানবোট কাবু করার জন্য ভারী অস্ত্রপাতি চেয়ে গেরিলারা আমার কাছে খবর পাঠালো। আমরা যদি জনগণকে এই অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা করতে না পারি, তাহলে যত রকমের সফলতাই আমরা অর্জন করিনা কেন, জনগন অচিরেই তা ভূলে