পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪৩৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
409

অর্ধ- আবৃত্ত তারপলিনের নীচে আবছা আলোতে ওরা সন্ত্রাসীদের দেখতে পেলো। হঠাৎ আকাশটা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। ভয়ানক বৃষ্টি। আঘাত করার সময় এসে গেল। ঠিক চারটা ত্রিশ মিনিট। যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করে ওরা লিম্পেট মাইনগুলো জাহাজের তলায় লাগিয়ে দিল। এই মাইনগুলোর উপরের দিকে চুম্বক লাগানো। লোহার সংস্পর্শে এলে গায়ে লেগে থাকে। তারপর ওরা সাঁতরিয়ে ঘাঁটির দিকে ফিরে চললো। এই সময় ওরা খুব তাড়াতড়ি সাঁতরাতে লাগলো। ওরা জানতো যে, মাইন লাগানোর এক ঘণ্টা পরে, এই সুন্দর জাহাজগুলো বিকট শব্দে বিদীর্ণ হয়ে প্রজ্বলিত অগ্নিশিখার বদ্যুৎসবে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকবে। মাইনগুলো বিস্ফোরণের জন্য 'ফিউজে' একঘণ্টা সময় বেধে দেয়া হয়েছিল- যেন ওরা নিরাপদ ঘাঁটিতে ফিরে আসতে পারে। আবেগ ও উত্তেজনায় উদ্বেলিত হয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে ওরা ষোলজন সবাই তীরে ফিরলো। যারা তীরে সাগ্রহে প্রতিক্ষায় ছিল, তারা সবাই ওদেরকে বুকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে চুমু খেতে লাগলো। শুয়ে পড়ে মুক্তিযোদ্ধারা অধীর আগ্রহে জাহাজগুলোর দিকে চেয়ে রইল- কখন সাড়ে পাঁচটা বাজবে। হ্যাঁ, চরম লগ্নটি এলো। সমস্ত পৃথিবীটাকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিয়ে বিকট শব্দে মাইনগুলো বিস্ফোরিত হলো। আটটি জাহাজের মধ্যে সাতটি ডুবে গেল। আমাদের উদ্দেশ্য সার্থক ও সফল হলো। এই ঘটনার পর বন্দরের শ্রমিকরা কাজ ছেড়ে দিয়ে যে যেদিকে পারলো পালিয়ে গেল। বেশ কিছুদিনের জন্য চালনা ও মংলা বন্দর জনশূন্য হয়ে পড়ে রইল।

 শমসেরনগরে ফিরে আসার সময় মৃত্যুঞ্জয়ী মুক্তিসেনারা একটা ফরেস্ট অফিসে হামলা চালিয়ে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ও অন্যান্য মুল্যবান জিনিসপত্র অধিকার করে। এর মধ্যে ‘বনবালা' ও ‘বনমৃগী’ এই দুটো লঞ্চও ছিল। এই লঞ্চে চেপে বিজয়ের উত্তেজনায় আত্মহারা মুক্তিযোদ্ধারা শমসেরনগরে ফিরে এলো। পাকিস্তানী ঘাঁটির অবস্থানের অনিশ্চয়তার জন্য লেঃ জিয়ার ত্রিকোণা অভিযান স্থগিত রাখা হলো। তাছাড়া আবহাওয়াও খুব অনুকুলে ছিল না। সব রকমের সতর্কতামুলক ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও গেরিলাদের ভেতর আসা বন্ধ করতে না পারায় পাক হানাদাররা ভয়ানকভাবে ক্ষেপে গিয়েছিল। সুতরাং ওরা সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে চালনা পোতাশ্রয়ের বিপরীত দিকে সুন্দরবনে আগুন ধরিয়ে দিল এবং গানবোট নিয়ে পাহারায় বেরিয়ে সন্দরবনের সমস্ত পথঘাট একদম বন্ধ করে দেয়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলো।

 সেপ্টেম্বরের শেষদিকে হানাদাররা শ্যামনগর ঘাঁটির গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারলো। আমাদের হাতেই কিছুদিন আগে এই ঘাঁটির পতন ঘটে। এবার শ্যামনগর ঘাঁটি পুনরুদ্ধার করার জন্য হানাদাররা গানবোট ও পদাতিক বাহিনী নিয়ে ভীষণভাবে আমদেরকে আক্রমণ করলো। তিনদিন তীব্র যুদ্ধ চালাবার পর, হানাদারদের চরম ক্ষতি করে, সমর-কৌশলের দিক দিয়ে খুব গুরুত্বপূর্ন এরকম অন্য একটা অন্য একটা জায়গায় আমরা সরে গেলাম। এই যুদ্ধে আমরা পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধকে হারিয়েছিলাম। এর মধ্যে সুবেদার মোহাম্মদ ইলিয়াস মেশিনগানের গুলিতে ঘটনাস্থলেই মারা যায়। আর চারজন নতুন- ভর্তি মুক্তিযোদ্ধাকে হানাদাররা বন্দী করে। শ্যামনগর পুনরুদ্ধার করে ও হানাদাররা গেরিলাদের ভেতরে যাওয়া বন্ধ করতে পারলো না।

 এক মাস পরে ঠিক একই উপায়ে ফ্রগম্যানরা আবার মংলা ও চালনা বন্দর আক্রমণ করলো। ১৬ই অক্টোবর আলম নামে পাক নৌবাহিনী থেকে পালিয়ে আসা একজন সৈন্যের অধীনে দ্বিতীয় দলটি শ্যামনগরের অনেক দক্ষিণ দিক দিয়ে হেঁটে ভেতরে গেল। এবারেও আমরা সফল হলাম। এই আক্রমণে শত্রুপক্ষে চারটি জাহাজ ডুবে গিয়েছিল। একটির নাম ‘লাইটনিং” এবং অপরটার নাম 'আল-মুরতজা'। অন্যগুলো চীনা জাহাজ বলে শনাক্ত করা হয়। আমাদের এই দ্বিতীয়বারের আক্রমণ চালনা ও মংলা বন্দরকে সম্পূর্ণ অকেজো করে দিল। এর উপরও নভেম্বর মাসে রহমতউল্লাহর নেতৃত্বে খুলনায় আক্রমণ চালিয়ে সাফল্য অর্জন করা হয়। বাংলাদেশ সশস্ত্র-বাহিনীর অন্যান্য সেক্টরের নির্দেশ অনুযায়ী চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ এবং চাঁদপুরেও শত্রু জাহাজের উপর আক্রমণ চালানো হয়।