পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪৩৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
411

ঘাঁটিগুলো ছেড়ে দিয়ে খুলনার দিকে হেঁটে গিয়ে জড়ো হয়েছে। আমি স্থির করলাম যেসব গেরিলা খুলনার সীমান্ত বরাবর শত্রহননে লিপ্ত, তাদেরকে খুলনা শহরের চারিদিকে সমাবেশ করে হানাদারদের পিছু হটার রাস্তা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেব। মিত্র বাহিনীর সার্বিক পরিকল্পনা মনে রেখে মাসের ১৫ তারিখে সাব- এরিয়া কমাণ্ডারদের নিয়ে আমাদের দপ্তরে একটা সম্মেলনে মিলিত হয়ে তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব সম্বন্ধে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলাম। খুলনা শহরের নিকট রূপসা নদীর পশ্চিম তীরে। আক্রমণব্যূহ তৈরী করার জন্য লেঃ জিয়াকে সুন্দরবন অঞ্চল থেকে ঘাঁটি গুটিয়ে ফেলার জন্য প্রয়োজনীয় আদেশ দিলাম। বাগেরহাটে সুবেদার তাজুল ইসলামের অধীনে যে সমস্ত সৈন্য ছিল তাদেরও লেঃ জিয়ার নিয়ন্ত্রণে কাজ করার জন্য নির্দেশ দিলাম। শত্রুপক্ষ যাতে নৌ- পথে ব্যবহার করতে না পারে, সে জন্য জৈনক মিঃ নোমানউল্লাহকে তেরখাদা ও মোল্লাহাটে যে সমস্ত মুক্তিযোদ্ধা ছিল, তাঁদের সাথে সমন্বয় স্থাপন করে খুলনার উত্তর-পূর্ব দিক থেকে এসে এক জায়গায় জড়ো হয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য সতর্ক থাকতে বললাম। আরও যেন পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষায় সর্বদা প্রস্তুত থাকে। খুলনার দক্ষিণে পাইকগাছা, তালা ও আশাশুনি অঞ্চলে সেকেণ্ড লেঃ আরেফিন গেরিলাদের হিসাবে কর্মরত ছিল। তাকে বললাম, সে যেন গেরিলাদের সঙ্গে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে খুলনা শহরের কাছাকাছি কোথাও প্রস্তুত হয়ে থাকে।

 ক্যাপ্টেন হুদার অধীনে দুই ব্যাটালিয়নের বেশী যোদ্ধা ছিল। তাকেও সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দিলাম। বসন্তপুরে শত্রুপক্ষের অবস্থান খুবই সুদৃঢ়। বসন্তপুর আমাদের খুবই নিকটে। একান থেকে হানাদারদের বিতাড়িত করে গুরুত্বপূর্ণ সাতক্ষীরা-দৌলতপর সড়কে শত্রুমুক্ত করে আধিপত্য বিস্তার করার জন্য ক্যাপ্টেন হুদাকে দায়িত্ব দিলাম। খুলনা শহরের চারিদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের জড়ো করে রাখার প্রধান উদ্দেশ্য হলো, দকরদার আমলে বিহারীরা বাঙালী মুসলমানদের উপর যে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়েছিল তারই প্রতিহিংসা নিতে গিয়ে অনিবার্য পরিণতি স্বরূপ ব্যাপক হারে বিহারী নিধন আরম্ভ হবে এবং সারাদেশ জুড়ে নেমে আসবে বিশৃংখলা। এই আশংকা করেই উপরোক্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। উল্লিখিত পরিকল্পনা ছাড়াও আমি দুটো দলকে প্রস্তুত করে বেগের নেতৃত্বাদননে বরিশালের দিকে নৌকায় পাঠিয়ে নিলাম। প্রথম দলটি ক্যাপ্টেন ওমরের সাথে সংযোগ স্থাপন করে বরিশালের উদ্ভূত পরিস্থিতির মোকাবেলা করবে আর দ্বিতীয় দলটিকে সেকেণ্ড লেঃ মুয়িনের নেতৃত্বে পটুয়াখালী পৌঁছানো হলো। কথা প্রসংগে বলতে হয় সেকেণ্ড লেঃ মুয়িন মিত্র বাহিনীর অধননে বিহার প্রবেশের 'মুর্তিহতে বাংলাদেশের ক্রাম ট্রেনিং কোর্স সমাপ্ত করে আরও চারজন তরুণ অফিসারসহ প্রথম দলে অক্টোবর মাসে আমার কাছে আসে। তারা তিনমাসের ক্রাশ ট্রেনিং প্রোগ্রাম অনুযায়ী শিক্ষা গ্রহণ করে। এই তিনজন অফিসার হলো- সেকেণ্ড লেঃ মোহাম্মদ অলি, আহসানউল্লাহ এবং শচীন্দ্র। তাদের সবাইকে ক্যাপ্টেন হুদার বাহিনীতে কাজ করার জন্য দেয়া হলো। বয়সে সবাই নবীন, কর্মক্ষম ও কষ্টসহিষ্ণু। যাহোক, নির্দেশ মোতাবেক লেঃ জিয়া, নোমান ও আরেফিন স্ব-স্ব গন্তব্যস্থলের দিকে রওনা হয়ে গেল। বসন্তপুরের উপর যে কোন সময় আঘাত হানার জন্য ক্যাপ্টেন হুদা প্রস্ত্তত হয়ে রইল। এই সময়ে লেঃ জিয়াকে একটা বেতারযন্ত্র যোগাড় করে দিলাম। ওদের সবাইকে পাঠিয়ে দিয়ে মনের গভীরে একটা প্রশ্ন উকি দিলে নিজেই বিস্মিত হলাম- এইবার কি সত্যিই আমরা খুলনা যাচ্ছি?

 ওদের যে সমস্ত আদেশ দিয়েছিলাম তা আমরা কানে অবিশ্বাস্য রকমের প্রতিধ্বনি হতে লাগলো। স্বপ্নাবিষ্টের মত মনে হলো, ওগুলো যেন আমাকেই উল্টে পরিহাস করছে। কেননা, দালালও হানাদার পরিবেষ্টিত খুলনার মত বিপজ্জনক শহরে এত শীগগীর প্রবেশ করতে পারবো- একথা কল্পনাও করতে পারিনি। যদিও স্থানীয় প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত অনেক মুক্তিযোদ্ধা ছাড়াও কমপক্ষে পাঁচ হাজার গেরিলা খুলনা শহরকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছিল, তবুও হানাদারদের প্রকৃত শক্তি সম্পর্কে আমরা ছিলাম সন্দিহান।

 সমস্ত শংকা, সমস্ত ভয় উবে গেল। চরম লগ্নটি সমাগত। পবিত্র ঈদের দিন সকালবেলা, ১৯৭১ সালের ২০শে নভেম্বর-ক্রিং ক্রিং করে টেলিফোনে কয়েকবার শব্দ হতেই রিসিভারটা কানের কাছে নিলামঃ অত্যন্ত সুখবর। প্রসংশনীয় তৎপরতা। অবস্থান মজবুত করে টিকিয়ে রাখো। কুত্তাগুলোকে পিছু পিছু ধাওয়া করো।'