পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪৩৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
414

লাগলো। স্পষ্ট বোঝা গেল যে হানাদাররা প্রথমে সাতক্ষীরায় ও পরে খুলনার দিকে পালাবার জন্য যুদ্ধে দীর্ঘসূত্রতার কৌশল অবলম্বন করেছে। এই ব্রীজের কাছ এসে উভয় পক্ষই মাঝে-মধ্যে মেশিনগানের ব্রাশ ফায়ার করে গুলি বিনিময় করতো। এখানে মূর্তজা নামে একজন মুক্তিযোদ্ধ কে হারাতে হয়। সে অত্যন্ত সাহসী এবং অনেক যুদ্ধে সক্রিয় অংশ নিয়েছিল। মাথায় বুলেটের আঘাত লাগার পর তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ওকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। কেননা, বুলেটের আঘাতে ওর মগজ বের হয়ে গিয়েছিল। যাহোক, আমরা সব সময় আত্মরক্ষামুলক আবস্থান থেকে শত্রুর প্রতিটি গতিবিধির প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখতাম।

 হানাদাররা যে সমস্ত জায়গা ছেড়ে পালিয়ে গেছে, তার খবরটা কোলকাতার জনগণের কাছ খুব দ্রুত পৌঁছে গেল। মুক্তাঞ্চল পরিদর্শন করার জন্য সাংবাদিক, টিভি ক্যামরাম্যান এবং আরও অনেক সম্মানিত ব্যক্তি আসতে লাগলেন।ইছামতীর পশ্চিম তীর লোকে লোকারণ্য, মনে হলো কোন জনাকীর্ণ মেলা। পরিদর্শনকারী দু'একটি দলকে জিজ্ঞেস করলাম, 'আপনারা এখানে ঘোরাঘুরি করছেন কেন? উত্তর এলো, মুক্তির আনন্দ, মেজর সাহেব- মুক্তির আনন্দ”।

 মুক্তির আনন্দই যেন বৈধ পাসপোর্ট। শিগগিরই মুক্ত-অঞ্চল লোকের আগমনে সরগরম হয়ে উঠলো। কোলকাতা থেকে শরণার্থীরা দলে দলে তাদের পরিত্যক্ত বাড়িঘরে ফিরে আসতে লাগলো। আবার নতুন করে ঘর বাঁধার প্রবল ইচ্ছা।

 এবার সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানী সাহেব মুক্তাঞ্চল সফর করতে এলেন। তাঁকে আমি রণাঙ্গনের অগ্রবর্তী এলাকায় নিয়ে গেলাম। কতকগুলো অসুবিধার জন্য সাতক্ষীরা থেকে আট মাইল দূরে আমাদের থামতে হয়েছিল।কি করে এই অসুবিধাগুলো দূর করা যায়, তাঁকে বুঝিয়ে বললাম। আমার পরিকল্পনা ছিল, সাতক্ষীরার পিছনে দু'দিক থেকে সৈন্য পাঠিয়ে হানাদারদের পালানোর পথ বন্ধ করে দেয়া এবং যাতে নতুন সৈন্য আমদানী করে শক্তি বৃদ্ধিকরতে না পারে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা। দু'টো প্রধান রাস্তা দিয়ে সাতক্ষীরার সাথে চলাচল ব্যবস্থার সংযোগ সাধন করা হতো। একটা হলো, যশোর থেকে কদমতলা হয়ে- অপরটা হলো কালিগঞ্জ থেকে যে পথ ধরে আমরা অগ্রসর হচ্ছিলাম, সেই পথ। এ রাস্তাটা সাতক্ষীরার ভেতর দিয়ে দৌলতপুর-খুলনা পৌঁছেছে। স্থির করলাম, প্রত্যেকটি রাস্তায় বাধা সৃষ্টি করবো।

 ২৯শে নভেম্বর, হাবিলদার আফজালের নেতৃত্বে দু'শো মুক্তিযোদ্ধার একটি দল সাতক্ষীরার পথে পাঠিয়ে দিলাম। কিন্তু যেভাবে তাকে নির্দেশ দিয়েছিলাম সেইমত কাজ করতে ব্যর্থ হলো। তারপর লেঃ আহসানউল্লাহর সেতৃত্বে দু'শো মুক্তিযোদ্ধার একটি দলকে ওই একই পথে পাঠানো হলো। আহসানইল্লাহ অত্যন্ত সাহসী যুবক। তার যোগ্যতা ও সামর্থ্য সম্বন্ধে আমি নিশ্চিত ছিলাম। এগিয়ে যাবার প্রচণ্ড শক্তি তার মধ্যে। ডানদিক থেকে একশো মুক্তিযোদ্ধার আর একটি দলকে মিঃ শাজাহানের নেতৃত্বে সাতক্ষীরা- দৌলতপুর রাস্তায় ওঁৎ পেতে শত্রুকে আঘাত করার জন্য পাঠিয়ে দিলাম। ক্যাপ্টেন হুদাকে বললাম যে, রাতের বেলায় আক্রমণাত্মক পাহারা দিয়ে শত্রুদের উপর চাপ সৃষ্টি করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সাতক্ষীরা অধিকার এবং সৈন্যদের দ্রুত পুনর্গঠিত করে পলায়নের পর শত্রুদের পিছু ধাওয়া করতে হবে।

 ইতিমধ্যে প্রশাসনিক ব্যবস্থার বৃহদাংশ নদীর ওপার থেকে দেবহাটায় স্থানান্তরিত করা হয়েছে। এখানে ভূতপূর্ব সি-এস-পি অফিসার মিঃ আতাউর রহমানের তত্বাবধানে পাঁচশো তরুণ যুবক নিয়ে একটা ট্রেনিং ক্যাম্প খুলে দিলাম। মিঃ আতাউর রহমান যুবক, কর্তব্যপরায়ণ। মুক্তিযুদ্ধে তিনি সর্বান্তকরণে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। এই যুদ্ধে তার দান অপরিসীম। শীগগীরই ক্যাম্পের কার্যাকলাপ সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র প্রযোজকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। সব মতাদর্শের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ক্যাম্প পরিদর্শনে আসতে লাগলেন। অনেক গণ্যমান্য লোকজন সাথে নিয়ে ও পুনর্বাসন মন্ত্রী মেঃ কামরুজ্জামান এই ক্যাম্প পরিদর্শন করে অত্যন্ত খুশী হলেন। ছেলেরা জয় বাংলা' ধ্বনি তুলে মন্ত্রী মহোদয়কে স্বাগত জানালে তিনি অভিভূত হয়ে পড়লেন। কিন্তু এই সৌজন্যমুলক