পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪৪২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
417

 ১০ই ডিসেম্বর,১৯৭১ সালঃ গত রাতে ঘুমাতে পারিনি। কামানগুলো ঝিমিয়ে পড়েছে। গুহায় আহত সিংহের মত কামানগুলো তবুও মাঝে মাঝে গোঙাতে লাগলো। ভোরে ঘুম থেকে উঠে এক মগ চা দিয়ে গলাটা ভিজিয়ে অগ্রবর্তী ঘাটিতে যুদ্ধরত সৈন্যদের কাছে গেলাম। এটা আমাদের দ্বিতীয় অবস্থান। সাতক্ষীরা দৌলতপুর রাস্তায় প্রায় একহাজার গজ সামনে মেজর ঠাকুরের নেতৃত্ব ১৩নং ‘ডোগরা' পদাতিক বাহিনী অবস্থান নিয়েছিল। অগ্রবর্তীদলের মর্টার সজ্জিত সৈন্য দলটিও এখানে অবস্থান নেয়। রাস্তার দু'দিকে খোলা জলাশয়, সব কিছুই চোখে পড়ে। রাস্তায় কোন রকম চলাচল করলেই শত্রুপক্ষের মেশিনগানগুলি গর্জে ওঠে। রাস্তাটা খুব উঁচু। খুলনায় অয়ারলেস স্টেশনের টাওয়ার ও দৌলতপুর পানির ট্যাংক ভালভাবে দেখা যায়। এত কাছে তবু সোজাসুজি যেতে পারছি না। খুলনাকে দেখে আমি খুবই তৃষ্ণার্ত ও উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। যেহেতু পিছন দিক থেকে অনেকটা পথ ঘুরে আসতে হয়, সেজন্য আমাদের সৈন্যরা দুদিক থেকে অগ্রসর হতে লাগলো। তাছাড়া মিত্রবাহিনীর আগে আমাদের যাবার কথা নয়। কাজেই আমাদের পিছনে থেকে যুদ্ধের গতিবিধি লক্ষ্য করা ছাড়া কোন উপায় ছিল না। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কথা বললাম। ওদের অধিকাংশই খুলনার লোক। দেখলাম, ওদের মনোবল খুবই উঁচু। ওদের ঘরদোরের করুন দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠলো। স্কুলে ফিরে এসে আমাদের যা কিছু আছে সব একত্র করার জন্য হুদাকে বললাম।সম্ভাব্য বিপদের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য ট্রেঞ্চ খনন করে তার ভেতরে আমরা আশ্রয় নিলাম। কেননা, এই জায়গায় শত্রুপক্ষের কামানোর আওতায়। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সতর্ক হয়ে প্রস্তুত রইলাম। আকাঙ্ক্ষিত চরম লক্ষ্যবস্তুর কত কাছে আমরা তবু কত দূরে।

 ১১ই ডিসেম্বর,১৯৭১ সালঃ যে দৃশ্য দেখেছি, তা জীবনের অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা হয়ে থাকবে। দেখলাম, সাতক্ষীরা-দৌলতপুর রোড লোকে লোকারণ্য। বিভিন্ন যুবকেন্দ্র থেকে ওরা দলে দলে ফিরে আসছে। যতদূর চোখ যায় শুধু লোক আর লোক। কাঁধে ছোট ছোট বোঝা। রিক্ত, নিঃস্ব, সম্বলহীন। ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে আসছে মানুষের কাফেলা। আল্লাহর অসীম অনুগ্রহ, আমরা ওই রাস্তার উপরই ছিলাম, নইলে ওই রিক্ত মানুষগুলো হিংস্র শত্রুদের খপ্পরে পড়ে যেতো। সামনে অগ্রসর হতে বারণ ওদের থামিয়ে দিলাম।

 একটা দোতলা দালান থাকার জন্য ঠিক করা হলো। ওদের খাওয়া-দাওয়ার বন্দোবস্ত করতে হবে। ভয়ানক চিন্তায় পড়ে গেলাম। ওরা প্রত্যেকেই এসে অভিযোগের সুরে বললো, 'স্যার, আমাদের সাথে কোন টাকা-পয়সা নেই। এম-এন-এ, এম-পি-এ'রা আমাদের ফেলে পালিয়ে গেছে।' মুখগুলো শুষ্ক, কুঞ্চিত। কেননা, পঞ্চাশ মাইল পথ ওদের পায়ে হেঁটে আসতে হয়েছে। মনটা আমার কেঁদে উঠলো। ওদের সান্ত্বনা দিয়ে একটা বড় লংগরখানা খোলার জন্য চৌধুরীকে বললাম। খুলনা মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের এখানেই থাকতে নির্দেশ দিলাম। চৌধুরীকে লংগরখানা দেখাশুনার ভার দিয়ে আমি হেডকোয়ার্টারের দিকে রওনা হয়ে গেলাম এবং ফুলতলা পৌঁছে ৯নং পদাতিক ডিভিশনের হেডকোয়ার্টারের সাথে যোগাযোগ করলাম। মেজর জেনারেল দলবীর সিং এই ডিভিশনের কমাণ্ডার।

 ফুলতলা থেকে কিছু সামনে খুলনার দিকে যে রাস্তাটা গিয়েছে তার ডানপাশে একটি কৃষি কলেজের মধ্যে হেডকোয়ার্টারের অফিসাদি। মেজর জেনারেল সিং-এর দেখা না পেয়ে তাঁর স্টাফ অফিসারের সংগে দেখা করলাম। এই ডিভিশনের একটি ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার থেকে তিন মাইল সামনে অবস্থান নিয়েছিল।

 পাক হানাদাররা এখানে তীব্র প্রতিরোধ দিয়ে খুলনা-যশোর উপর মিত্রবাহিনী অগ্রগতি বন্ধ করে দিল। অবিরাম গোলাবর্ষণ চলতে লাগলো। মনে হলো, খুলনার শত্রুপক্ষ সুদৃঢ় ঘাঁটি গেড়েছে। সীমান্ত ও যশোর ক্যাণ্টনমেণ্ট ছেড়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা জড়ো হয়েছে খুলনায়। কেননা, মুক্তিবাহিনী চতুর্দিক থেকে ওদের ঘিরে রেখেছে। হানাদাররা মিত্রবাহিনীর চাইতে মুক্তিযোদ্ধাদের বেশী ভয় করতো।

 ১৩ই ডিসেম্বর,১৯৭১ সালঃ আমাদের আত্মরক্ষামূলক অবস্থানের সামনে শত্রুঘাঁটির উপর বিমান হামলা পর্যবেক্ষণ করার জন্য আমি, ৯নং ডিভিশনের স্টাফ অফিসার মেজর ভট্টাচার্য, ভারতীয় বিমান বাহিনীর ফ্লাইট লেফটেন্যাণ্ট দত্ত আমাদের দ্বিতীয় অবস্থানে বসে সারা দিন অপেক্ষা করলাম। মিঃ দত্তের নির্দেশে এই বিমান