পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪৫১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
426

আমাদের দুজন শহীদ হন। যে দুজন শহীদ হয়েছিলেন তারা কৃষক। আকস্মিক আক্রমণে তারা হতবুদ্ধি হয়ে যান। মহিষপুর থেকে অবস্থান তুলে নিয়ে আমরা অন্যত্র চলে যাই। পাকসেনারা পরে এসে মহিষপুরের পার্শ্ববর্তী গ্রামটি জ্বালিয়ে দেয়।

 আগষ্টের শেষে ১৬ বছরের এক মুক্তিযোদ্ধা পটুয়াখালী সার্কিট হাউসে অবস্থানরত পাকসেনাদের লক্ষ্য করে ২টি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এতে তাদের কেই মারা না গেলেও বেশ কয়েকজন আহত হয়।

 সেপ্টম্বরের প্রথম সপ্তাহে পাকসেনারা পটুয়াখালীর নিকটবর্তী গ্রামে প্রবেশ করে ৫/৭ জন যুবক- বৃদ্ধকে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে গ্রেপ্তার করে এবং তাদের মেরে ফেলবার জন্য নদীর পাড়ে নিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা এ খবর পেয়ে দ্রুত সে অবস্থানে গিয়ে পাকসেনাদের উপর গুলি চালায়। পাকসেনারা এতে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বন্দীদের ছেড়ে পালিয়ে যায়। যাদের বন্দী করা হয়েছিল তাদের মধ্যে একজন নিহত হয়। এর ফলে জনগণের মনে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর আস্থা বেড়ে যায়।

 সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বেড়ে যায় এবং তাদের গ্রুপগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় কারা কত ভাল অপারেশন করছে তাই নিয়ে। দালালরা গ্রাম ছেড়ে শহরে আশ্রয় নেয়। পাকসেনাদের গতিবিধি অনেক কমে যায়। পাকসেনাদের গ্রামে দেখলেই মুক্তিযোদ্ধারা তাদের উপর হামলা চালাত। পটুয়াখালী, বরগুনা ও ৮টি থানা সদর এলাকা ছাড়া সমগ্র পটুয়াখালী এলাকা ছাড়া সমগ্র পটুয়াখালী এলাকা আমাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।

 বস্ত্ততঃপক্ষে এই সময় পটুয়াখালী জেলার সমস্ত থানা দপ্তর ছাড়া বাকি সমগ্র এলাকা মুক্তিযোদ্ধারা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। সারা সেপ্টেম্বর মাসই দুর্জয় মুক্তিফৌজ ক্রমাগত শত্রুর উপর ছোটখাটো হামলা চালায়। বস্ত্ততঃপক্ষে শহর ছাড়া সমস্ত এলাকায় শত্রুর গতিবিধি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয়। এই সময় সমস্ত মুক্তিফৌজের মধ্যে একটা চর্মরোগ দেখা দেয়ায় মুক্তিযোদ্ধারা অবরুদ্ধ শত্রুর ঘাঁটির উপর আক্রমণ চালাতে পারেনি। তথাপি এই মাসে মুক্তিফৌজ প্রায় শ'খানেক অস্ত্র শত্রুর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিল।

 সেপ্টেম্বরের শেষার্ধ থেকে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আক্রমণ আবার জোরদার করতে শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ভেঙ্গে গেছে, অস্ত্র নেই-পাকসেনারা এটা মনে করে আবার গ্রামের দিকে ঢুকতে ব্যর্থ প্রয়াস চালায়। এই সময় পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ জনগনের মধ্যে বিভ্রান্তি এবং ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি জন্য প্রচারণা চালাতে থাকে যে, “তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধারা' প্রকৃতপক্ষে ভারতের সৈন্য এবং হিন্দু। এরা মুসলমান ধর্ম, কৃষ্টি সমাজ ব্যবস্থা ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এই প্রচারণায় জনগণ মোটেই বিভ্রান্ত হয়নি। কারন, মুক্তিযোদ্ধারা তাদেরই পরিচিত লোক

 মুক্তিযোদ্ধারা সর্বদা ভাবতো জয় তাদের সুনিশ্চিত। কারন পাকিস্তান সেনাবাহিনী কোণঠাসা হয়ে গেছে। তাই এই সময় মুক্তিযোদ্ধারা আগের মত অতটা সতর্ক থাকত না। এর পরিণতিতে অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি বরগুনার দক্ষিণে কুয়াকাটা কাছাকাছি একদল মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানী সৈন্যদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা বরগুনার দিকে আসছিল। চারটা নৌকায় করে অতর্কিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তাদের উপর প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ শুরু করে। আক্রান্ত হয়ে বাধ্য হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা জঙ্গলের ভেতর ঢুকে পড়ে। পাকবাহিনীর প্রায় আড়াই দিন ধরে গুলি ছুঁড়তে থাকে। সেই গোলাগুলির সময় আমাদের কিছু অস্ত্রশস্ত্র নদীতে ডুবে যায়। সেখানে থাকাকালীন মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার-দাবারের ভীষণ অসুবিধা হয়।

 সেখান থেকে আমরা বরগুনা শহরের দিকে অগ্রসর হতে থাকি। বরগুনা থেকে আড়াই মাইল দূরে পাকিস্তানী চেকপোস্টের উপর মুক্তিযোদ্ধারা হামলা চালায়। চেকপোস্টের ১২ জন পাকিস্তানী সৈন্য ছিল। স্থানীয় জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধারা ঐ চেকপোস্টের ঘিড়ে ফেলে। রাত বারটার দিকে তাদের উপর আচমকা হামলা চালানো হয়। মাত্র দেড় ঘণ্টার যুদ্ধে ঐ চেকপোস্ট মুক্তিযোদ্ধারা দখল করে ফেলে। এখানে মুক্তিযোদ্ধারা ২৮ জনকে