পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪৫৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
432

একটু দূরেই একটা বাঁধ। আমাদের ক্যাম্পের দিকে পশ্চিম থেকে যদি খানসেনাদের আসতে হয় তবে ঐ বাঁধ পেরিয়ে আসতে হবে। শওকত দেখল খানসেনাদের একটা দল উত্তর দিকের রাস্তার পাশে পজিশন নিয়ে শুয়ে আছে। বাকী তিনটা দলের একটা আমাদের সেণ্টারের পশ্চিম পাশ দিয়ে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আর বাকী দুটো দল পশ্চিম দিক থেকে আমাদের ক্যাম্পের দিকে আসছে। এই দুটোর একটা দল পশ্চিম দিকের একটা বাড়ির মধ্যে আত্মগোপন করে রইল। বাকীটা ২৫/৩০ জনে বিভক্ত হয়ে আগে-পাছে আমাদের ক্যাম্পের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ওদের এই চতুর্থ দলে সর্বমোট প্রায় ৭০/৮০ জন খানসেনা ও দালাল সেনা।

 শওকতের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য নিয়ে সকল পজিশনে আমাদের প্লানটা জানিয়ে দিলাম। এস- এল-আর, ৩০৩ রাইফেল, ৩৬-এইচ-ই গ্রেনেড নিয়ে সবাই মাটির সাথে লতাপাতার সাথে এক হয়ে গেছি আর এক দুই করে আসল সময়ের অপেক্ষা করছি। শওকতের কথাই ঠিক হলো, রবিনদের সামনের সেই বাঁধটার দিকে পাকসেনারা অগ্রসর হচ্ছে। প্রথম ব্যাচে ২৫/৩০ জন। ১৫/২০ জন পশ্চিমা খান আর বাকীগুলো রাজাকার, পুলিশ। রবিনরা তাক করে শুয়ে আছে। অতি সতর্কতার সাথে খানদের দল বাঁধের উপর উঠে এসেছে। ৩/৪ জন বাঁধ পার হয়ে গেছে। অমনি রতনদের দল ট্রিগার টিপল। গুডুম গুডুম কয়েকটা শব্দ এবং সাথে সাথে গোমেজ ছুড়ে মারল গ্রেনেড। ২টা পুলিশ ও ৬টা খানসেনা লুটিয়ে পড়ল। ছিটকিয়ে গেল খানদের দল। পুলিশ রাজাকারদের সামলাতে তাদের বন্দুক উঁচিয়ে রাখতে হল। খানদের দল পিছিয়ে গেল খানিকটা। এটা ঘটল সকাল ৮ টার দিকে। আমরা চুপচাপ। শওকত আবার চলে গেল ওপিতে-দেখল ওদের গতিবিধি। পাকা তিন ঘণ্টা ধরে ওরা ওদের ছিটকিয়ে পড়া সাথীদের পশ্চিমে একটা বাড়ির আড়ালে একত্রিত করল। এর মধ্যেই খবর এল ৩৭৫ জনের এই দলটি পরিচালনা করছেন পটুয়াখালী জেলার পাক জান্তা প্রধান মেজর ইয়ামিন নিজে। আমরা দলে ছিলাম ৬০ জন মাত্র। অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে একটা এল-এম-জি, এস-এল, আর, ৬টা স্টেনগান, ৩৫টা ৩০৩ রাইফেল। ওদের কাছে ২টা ২" মর্টার, ৭/৮ টা এল-এম-জি, চাইনিজ স্বয়ংক্রিয় রাইফেলসহ বহু আধুনিক হালকা অস্ত্রশস্ত্র। আমাকে খবরটা দিয়েছিল ওদেরই দলের একটা পুলিশ। প্রথমবারের গোলাগুলির সুযোগে পালিয়ে এসে আমাকে খবরটা দিয়ে সে আবার চলে গেল। একটু ঘাবড়ে গেলাম। কিন্তু মনের দুর্বলতা কাউকে টের পেতে দিলাম না। সকলকে সাহস দিয়ে চাঙ্গা রাখলাম। প্রথম দফায় খানদের হটিয়ে দিয়ে এবং ৮ জনকে খতম করে প্রত্যেকের মনেই আনন্দ লেগেছে।

 আনুমানিক বেলা ১ টার দিকে ওরা আবার আমাদেরকে তিনদিক দিয়ে ঘিরে ফেলল। দক্ষিণ দিকটা খোলা রেখে পশ্চিম-উত্তর ও পূর্ব দিক থেকে ওরা আক্রমণ চালাল। পূর্বদিক দিয়ে ওরা আমাদের ক্যাম্পে আসতে পারবে না, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিন্ত ছিলাম। কারণ ঐ দিকটার ছিল অনেকখানি ধানের মাঠ। বহু দূরে থেকেই ওদেরকে দেখা যাবে। ভয় হল উত্তর এবং পশ্চিম দিকটা নিয়ে। এই দুটো দিক শক্তিশালী করলাম। সব ধরনের ঝংকার তুলে বেপরোয়া হয়ে খানদের দল এগিয়ে আসতে লাগল। আমরাও মরীয়া হয়ে পাল্টা জবাব দিলাম। সুবিধা ছিল ধান খেতের মধ্যে পালিয়ে পালিয়ে আসলেও আমরা ওদের গতিবিধি দেখতে পাই। কিন্তু ওরা আমাদের টিকিটিরও সন্ধান পায় না। ওদের দল থেকে আর্তনাদের শব্দ আমরা যতই শুনছি সাহস আমাদের ততই বাড়ছে। তবুও ওরা থামে না। কয়েকটা ২" মর্টারের শেল আমাদের ট্রেঞ্চের আশেপাশে পড়ল। মাটি নরম থাকায় বাস্ট করল না সেগুলো।

 ঠিক এমনি সংকটের সময়ে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিল আমাদের এল-এম-জি গ্রুপ। এল-এম-জি'টা নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল আবুল। চোরা গলিপথ দিয়ে বিভিন্ন কোণে আরম্ভ করল ফায়ার। একবার পশ্চিম দিকের বাড়িগুলো উপর, আবার একটা দৌড়ে সেখান থেকে সরে এসে উত্তর দিকে ওদের পজিশন বরাবর, আবার তার পর মুহূর্তে পূর্ব দিকে ওদের পজিশনের দিকে মুখ রেখে। ওদেকে এস এল-আর, স্টেনের স্বয়ংক্রিয় ফায়ারিং তো চলছেই। রাইফেল বসে নাই। গ্রেনেডও ফুটছে দুটো একটা। সে এক গগনবিদারী শব্দতাণ্ডব। খানদের পজিশন থেকে চেঁচামেচি -কান্নাকাটি আরও বাড়ল। পুলিশ-রাজাকারদের রাইফেল পয়েণ্ট রাখাও আর সম্ভব হল না। রাইফেল ফেলে যে যেদিকে পারলো পালালো। অল্প কয়েকজন পা-চাটা বাঙ্গালী দালাল, তখনও মেজর