পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪৫৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
433

ইয়ামিনের চারদিকে ঘুরছে। আমি ছিলাম পশ্চিম পার্শ্বে আমাদের পজিশনের সবচেয়ে সামনের লাইনে। সিভিল ড্রেসে চীনা রাইফেল হাতে লম্বা একটা লোক নজরে পড়ল। তার সাথে কয়েকটি খানসেনা। প্রায় এক হাজার গজ দূরে ছিল ওরা। তাক করে টিপলাম এস-এল-আরের ট্রিগার। শুয়ে পড়ল সিভিল ড্রেসধারী। ভাবলাম শেষ। কিন্তু শেষ হয় নাই। শুনেছি তিনিই ছিলেন মেজর ইয়ামিন। ঐ যে শুলেন আর উঠলেন গিয়ে ১ মাইল দূরে একটা নদীর পাড়ে, যেখানে তার জন্য স্পীডবোট তৈরী ছিল- অর্থাৎ প্রায় ১ মাইল পথ তিনি কখনও রোলিং কখনও ক্রলিং করে কোন রকমে কাদামাখা হয়ে স্পীডবোটে উঠে এক চম্পটে পটুয়াখালী।

 ওদের আক্রমণের দ্বিতীয় পর্যায়ে আমরা প্রধম দিকে ওদের কয়েকজনকে খতম করি এবং তার পরে পূর্বে পরিকল্পনা অনুসারে তিনদিকে সমানে গুলি ছোড়া আরম্ভ করি, তার উপরে ছিল আবুলের এল-এম-জি চালানোর কৌশল। এতে করে ওরা আমাদের বিরাট বাহিনী ভেঙ্গে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। মোটামুটি বিকেল ৪ টার দিকে অপর পক্ষের আর কোন সাড়া শব্দ পেলাম না। যে যেখান দিয়ে পেরেছে পালিয়ে বেঁচেছে। ৩০/৩৫ টা লাশ রেখে “মুক্তি বহুত হারামী হায়” বলে মামা আপন প্রাণ বাঁচা সার বলে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করল।

 আমাদের দলের রবিনের ডানহাতে একটা গুলি লেগেছিল। কিন্তু কাউকে না জানিয়ে গামছা দিয়ে বেঁধে সে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করেছে। আমার দলের অর্ধেকের বয়েস ছিল বিশ্বের নীচে এবং কারো বয়সই ২৮- এর উপরে ছিল না। একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি যে, ২০-এর নীচের কচি ছেলেগুলো সবচেয়ে নয়, আমি যে ক'টা যুদ্ধের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলাম তার প্রায় সব যুদ্ধের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে এ কথা বলা যায়।

 পল্লীর পর্ণকুটিরের আধা-শিক্ষিত অশিক্ষিত মানুষদের দেশপ্রেমের কথা কোনদিন ভুলতে পারব না। ওরা বন্দুক চালাতে পারে না। আধুনিক অস্ত্রের সামনে তারা তাই নিরূপায়। কিন্তু প্রাণের যে আবেগের পরিচয় তারা বিশেষ করে ঐ পানপট্টির যুদ্ধের দিনে দেখিয়েছিল তার মর্যাদা দেবার মত যোগ্যতা আমার নেই। গ্রামবাসীরা জানত, আমরা সকালে কিছু মুখে দিতে পারি নাই। পাক হানাদারদের রেইঞ্জের দূরের গ্রামে আমাদের জন্য মুড়ি, চিড়ে, গুড়, শতে শতে ডাব কেটে বালতি ভরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লোকেরা পৌঁছিয়ে দিয়েছিল। ছোট ছোট জঙ্গলের বাঁকে বাঁকে তারা আটার রুটি, গুড় এসব যে যেখান থেকে পেরেছে পাঠিয়ে দিয়েছিল- নিয়ে এসেছিল। বিকেল ৫ টার সময় আসা আরম্ভ করল ভাত, তরকারি, ডাল ইত্যাদি। এসকল খাদ্যসামগ্রী এত বেশী হারে এসে জমা হল যে আমরা ১৫ দিন বসে খেয়েও শেষ করতে পারতাম না।

 গলাচিপা আক্রমণঃ ৩/৪ দিন পরে ঠিক করলাম ওদের ঘাটি আক্রমণ করতে হবে। শওকতকে প্রধান করে জাহাঙ্গীর, মোস্তফা, হাবিবসহ ৩৫ জনের একটা দল পাঠালাম গলাচিপা আক্রমণ করতে। ওরা ঠিক পরিকল্পনা মত আক্রমণ করল। মারা গেল বিপক্ষের কয়েকজন। দিন শেষ হয়ে গেল। ওরা ফিরে এল শিবিরে। আবার পরিকল্পনা করল সেই রাতেই আক্রমণ করার। কিন্তু রাত আর আসতে পারল না। দুপুরের দিকে সদলবলে থানা ছেড়ে পটুয়াখালীর দিকে চম্পট। খবরটা পেলাম রাতে। শওকত লাফিয়ে পড়ল। তখনই ১০ জনের একটা দল নিয়ে সে চলে গেল গলাচিপায়। পরের দিন বাকী সকলকে নিয়ে আমিও গিয়ে পৌঁছলাম। পটুয়াখালী থেকে জাতিসংঘের একটা ছোট জাহাজে কয়েকজন পুলিশ দিয়ে মেজর ইয়ামিন একটা দল পাঠালেন পর্যবেক্ষণ করতে, অর্থাৎ গলাচিপার খবরাখবর সংগ্রহ করতে।

 শব্দ শুনে রেডি হলাম। কিছুক্ষণ পর চোখে পড়ল জাতিসংঘের জাহাজটা গলাচিপা বন্দরের দিকে এগিয়ে আসছে। আমরা ওঁৎ পেতে থাকলাম। আওতার মধ্যে আসার সাথে সাথে আক্রমণ চালালাম। প্রায় ১ মাইল এলাকা নিয়ে আমরা পজিশন নিয়েছিলাম। বাঙালি পুলিশগুলো তাদের হাতের অস্ত্রশস্ত্র সব নদীতে ফেলে দিল। শেষ পর্যন্ত কূলে ভিড়লো জাহাজটি। চেষ্টা করেছিল কাটিয়ে যেতে, কিন্তু পারল না। দখল করলাম জাহাজটি। ওটার নাম ছিল ' বাট্টি-মে-বি'। মালয়েশিয়ার লোক ছিল ক্রু। তাদের কাছ থেকে আমাদের এয়ার ফোর্স-এর