পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪৭৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

451 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খন্ড বাংলাদেশের অভ্যন্তরের আমার এলাকায় সম্পূর্ণ নিজের প্রচেষ্টায় ভালুকা এলাকাতে মেজর আফসার, রৌমারী এলাকাতে সুবেদার আলতাফ এবং টাঙ্গাইল এলাকায় কাদের সিদ্দিকী প্রচুর নিজস্ব বাহিনী গড়ে তুলে পাকিস্তানীদের বিরুদ্দে অপারেশন চালান। বাংলাদেশের সামগ্রিক যুদ্ধকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। (১) সশস্ত্র গণঅভু্যত্থানঃ যেখানে বাঙ্গালী ট্রপস যোগ দিয়েছিল- মার্চ, এপ্রিল। (২) দ্বিতীয় স্তরঃ গেরিলা যুদ্ধ শুরুর প্রস্ততি- মে. জুন, জুলাই (৩) তৃতীয় স্তর: গেরিলা যুদ্ধ অব্যাহত থাকে। আমাদের গেরিলা ফোর্সকে নিয়মিত বাহিনীতে নিয়ে যাবার যে পর্যায় এসেছিল তা কাজে লাগানো হয়নি। কয়েকটি অপারেশনের বর্ণনা ৷ চিলমারীঃ যুদ্ধের ইতিহাসে একটি বিস্ময় ॥ বিশাল ব্ৰহ্মপুত্রের অপর তীরে অবস্থিত চিলমারীর দুর্ভেদ্য শত্ৰবু্যহে এক প্রচন্ড হানা দিয়ে আমরা শত্রর বিপুল ক্ষতিসাধন করি। এই আক্রমণের মুক্তিবাহিনীর মূল আক্রমণ ভেবে সে এলাকায় বৃহৎ আকারের শক্ৰ সমাবেশ ঘটে। এধরনের আক্রমণ কে শুধুমাত্র দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন মিত্রবাহিনীর ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রমণের কয়েকটি ঘটনার সঙ্গে তুলনীয়। এক্ষেত্রে সুশিক্ষিত কয়েক ডিভিশন ছাত্রীসেনা এবং স্পেশাল ফোর্স অংশগ্রহণ করেছিলেন। সে যুদ্ধের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়নে কয়েক ডজন জেনারেল অংশগ্রহণ করেছিলেন। যুদ্ধের ইতিহাসে চিলমারী বন্দর আক্রমণ একটি উজ্জল ঘটনা। এই যুদ্ধ বাংলার সোনার ছেলেদের নিয়ে গঠিত আমার সেক্টরের প্রাইভেট আর্মি দ্বারা সংঘটিত হয়। রৌমারীর মুক্তাঞ্চলে মাত্র ১৫ দিনের অনুশীলনপ্রাপ্ত এ সমস্ত ছেলের নিয়মিত খাবারের সরবরাহ ছিল না, হাতখরচ ব্যবস্থা ছিল না এবং শুধুমাত্র দখলীকৃত অস্ত্রের উপরই তাদের নির্ভর করতে হতো। কোন অনুমোদিত ট্রেনিং ক্যাম্পে অনুশীলনপ্রাপ্ত না হওয়ায় এসমস্ত মুক্তিযোদ্ধারা সেক্টর কমান্ডারের প্রাইভেট আর্মি হিসেবে পরিচিত ছিল। তাদের চিলমারী আক্রমণ পরিকল্পনায় দক্ষতা এবং সাহস ও নৈপুণ্যের সাথে তার বাস্তবায়নের বিষয় যুদ্ধবিদ্যার ছাত্রদের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকে। ১১নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার হিসেবে যখন আমি দায়িত্ব গ্রহন করি তখন বেশ অনেকগুলো চরের সমন্বয়ে গঠিত বিশাল রৌমারী এলাকা মুক্ত ছিল। এর প্রতিরক্ষা আমাদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছিলো, কারণ মুজিব নগর থেকে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারকে আমরা সেখানে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম। মেজর জিয়ার (বর্তমানে মেজর জেনারেল) ব্রিগেডের দুটো বেঙ্গল রেজিমেন্ট এই মুক্তাঞ্চল প্রতিরক্ষার কাজে নিয়োজিত ছিল। শুধুমাত্র কোদালকাঠী চর ছাড়া ব্ৰহ্মপুত্রের পূর্বপারের সকল এলাকা মুক্ত ছিল। কোদালকাঠিতে শত্রসৈন্যের অবস্থান স্থানীয় গ্রামবাসীদের জন্য ত্রাসের কারণ হয়ে দাড়িয়েছিলো। এ সকল শত্রসৈন্য প্রায়ই পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে ঢুকে পড়ে গ্রামবাসীদের উপর অত্যাচার চালাতো। ব্ৰহ্মপুত্রের পূর্বাঞ্চলকে সম্পূর্ণ শত্রমুক্ত করার জন্য সুবেদার আফতাবের নেতৃত্বে দুই কোম্পানী মুক্তিযোদ্ধা সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকের এক রাতে গোপনে কোদালকাঠিতে অনুপ্রবেশ করে এবং শত্রবৃহের মাত্র কয়েকশত গজ দূরবর্তী ঝাউবনে ট্রেঞ্চ খনন করে তাতে অবস্থান করতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের পরিখাগুলোর সামনেই শত্রনিধনের উপযোগী বিস্তৃত খোলা জায়গা ছিল। আমাদের কৌশলের মূল উদ্দেশ্য ছিল, এই মক্তিযোদ্ধদের পরিখাগুলোতে উপস্থিতি টের পেয়ে যখন শত্রসৈন্য তাদেরকে উৎখাত করার জন্য আক্রমণ চালাবে, তখন আক্রমণোদ্যত শত্রসেনাদেরকে খোলা জায়গায় পেয়ে আমরা তাদের নিশ্চিহ্ন করবো।