পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪৭৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
453

দুই কোম্পানী নিয়মিত সৈন্য এবং দুই কোম্পানী মিলিশিয়া অবস্থান করছিলো। তারা চিলমারীর ওয়াপদা ভবন, জোরগাছ, রাজভিটা, থানাহাট পুলিশ স্টেশন, বলবাড়ী রেলওয়ে স্টেশন এবং পুলিশ স্টেশন সংলগ্ন রেলওয়ে ব্রীজে মোতায়েন ছিল। তাদের সাথে ছিল কুখ্যাত ওয়ালী মাহমুদ ও পাচু মিয়ার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা বড় আকারের এক রাজাকার বাহিনী।

 শত্রুকে প্রচণ্ড আঘাতে হানার জন্য আমাদের দরকার ছিল একই সময়ে বিভিন্ন শত্রুসৈন্যদের আক্রমণ করা এবং স্ব অবস্থানে তাদের আটক রাখা যাতে করে তার একে অপরের সাহায্যে বিশেষ করে চিলমারীতে সাহায্যকারী শত্রুসেনা এগিয়ে আসতে না পারে। সেজন্য চিলমারীর বেশ পেছনে রেল এবং সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার জন্য একটি দল পাঠানোর প্রয়োজন ছিল। এ অভিযানের সাফল্যের চাবিকাঠি নিহিত ছিল। শত্রুর অজ্ঞাতে অতর্কিত আক্রমণের উপর। এক বিরাট বাহিনীর পক্ষে সকলের অগোচরে প্রায় ৩২ মাইল প্রশস্ত ব্রহ্মপুত্র পাড়ি দেয়া সহজ ভ্যাপার ছিল না। এছাড়া মূল আক্রমণকে সমর্থন দেয়ার জন্য যে চারটি দূরপাল্লার কামান আমাদের কাছে ছিল সেগুলো নিকটবর্তী এক চরে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল। শত্রু সম্পর্কে বিভিন্ন খবর সংগৃহীত হলো। প্রস্তুতি পর্ব সম্পন্ন হলো। বিভিন্ন অবস্থানের শত্রুদের উপর একই সাথে আঘাত হানার জন্য বিভিন্ন সময়সূচী আমরা পুংখানুপুংখভাবে পরীক্ষা করে দেখলাম। এই অভিযান বিফল হয়ে যাওয়ার একটিমাত্র সম্ভাবনা ছিল, সেটি হচ্ছে যদি কোন অতিউৎসাহী মুক্তিযোদ্ধা আক্রমণ মুহূর্তের পূর্বেই উত্তেজনাবশতঃ কিছু করে বসে।

 অক্টোবরের ৯ তারিখে সড়ক এবং রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্নকারী দলটি প্রত্যেকের নির্দিষ্ট কাজের নির্দেশ নিয়ে সন্ধার পর রওনা হলো। গোপন ও অতি সন্তর্পণে এই দলটিকে উলিপুর এবং চিলমারীর মাঝামাঝি স্থানে ঘাঁটি স্থাপন করে মূল আক্রমণ শুরু না হওয়া পর্যন্ত আত্মগোপন করে থাকতে হবে। ১১ই অক্টোবর মূল বাহিনী চিলমারীর উদ্দেশ্যে রওনা হলো। অনেকগুলো বেশী নৌকা তাদের বহন করে এগিয়ে চললো। একসাথে এতগুলো দেশী নৌকার ব্যবস্থা করা ও তাদের বিভিন্ন অবস্থান থেকে গোপনে একই সময়ে শত্রুঘাঁটির কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া সে সময়ে বড় কঠিন ব্যাপার ছিলো। কমাণ্ডার আবুল কাসেম চাঁদ, ঢাকা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এ ব্যাপারে এগিয়ে এলো আর সমস্ত ব্যাবস্থা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করলো। রাতের অন্ধকারে দূরপাল্লার কামানগুলো চালিয়াপাড়ায় স্থাপন করা হলো। এই ভারী অস্ত্রগুলোকে নৌকা থেকে নামিয়ে বালুচরের উপরদিয়ে টেনে নিয়ে নির্ধারিত স্থানে স্থাপন করা হলো। এই ভারী অস্ত্রগুলোকে নৌকা থেকে নামিয়ে বালুচরের উপর দিয়ে টেনে নিয়ে নির্ধারিত স্থানে স্থাপন করা যে কি বিপজ্জনক এবং কঠিন ছিল তা লিখে বুঝানো যাবে না।

 স্বাধীনতা যুদ্ধের আর এক অসমসাহসী সৈনিক নায়েব সুবেদার মান্নান। তার উপর ন্যস্ত ছিলো ওয়াপদা ভবন ধবংস করার দায়িত্ব। ওখানে পাকিস্তানী অফিসাররা প্রমোদ বিলাসে মত্ত থাকতো। আমরা মাত্র দুটি রকেট লাঞ্চার তার দলকে দিতে পেরেছিলাম। কমাণ্ডার চাঁদের নেতৃত্বে বিভিন্ন দল গোরগাছা, রাজভিটা, তানাহাট পুলিশ স্টেশন এবং ব্রীজ অবস্থান আক্রমণের জন্য নির্দিষ্ট হলো। এদের অর্ধেকের সাথে ছিলো ৩০৩ রাইফেল, কিছু পুরোনো স্টেনগান আর বাকিদের কাছে শুধুমাত্র গ্রেনেড। মূল বাহিনীর এই ছোট ছোট দলগুলোর নেতৃত্ব দিচ্ছিলো খালেদ দুল, সুলায়মান, নূর আহম্মেদ আলো আর নজরুল। বলবাড়ি পুলিশ স্টেশনের জন্য কোন দল পাঠানো হয়নি, কারণ আমাদের জানা ছিল শত্রুসেনারা রাতে সে অবস্থান ছেড়ে চলে আসতো। আক্রমণ পরিচালনার জন্য চালিয়াপাড়ায় আমি আমার হেডাকায়র্টার স্থাপন করলাম। চিলমারীর দুই মাইল দক্ষিণে গাজীর চরকে আক্রমণকারী বাহিনীর আক্রমণের পূর্ব মুহুর্তের ঘাঁটি হিসেবে বেছে নেয়া হলো।

 গভীর রাত। ১টা সময় খবর এলো আমাদের সম্পূর্ণ বাহিনী আক্রমণস্থলের নিকটবর্তী ঘাঁটিতে পৌঁছে গেছে এবং যার যার নির্দিষ্ট আক্রমণস্থলের উদ্দেশ্যে যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছে। গ্রাউণ্ড সিট বিছিয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম এবং সাড়ে তিনটায় আমাকে জানানো হলো কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার বাহিনী শত্রুসেনার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। নানা ভাবনা সেই স্বল্প সময়টুকুতে আমার মনে ভীড় জমালো। হাতিয়ারের অভাব, অল্পবয়সী ছেলেরা-এরা কি পারবে এই বিরাট আক্রমণে সাফল্য লাভ করতে? কি হবে ওখানকার জনসাধারণের, যখন