বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪৮৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দশম খণ্ড
458

গুলিতে নিহত হয়। যখন এই গুলি বিনিময় চলছিল তখন একদল পাকিস্তানী সৈন্য কামালপুর ঘাঁটি থেকে পালিয়ে বকশিগঞ্জ যাচ্ছিল। এই পলাতক দলটি সে সময় এ্যামবুশকারী দলটি পেছনে এসে অবস্থান নেয় ও তাদের উপর গুলি চালায়। এতে ৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন ও ৪ জন পাকিস্থানীদের হাতে ধরা পড়েন। এই আকস্মিক বিপর্যয়ে অ্যাশকারী দলটি তাদের অ্যামবুশস্থল পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এই বিপর্যয় না ঘটলে সেদিন একটি পাকিস্তনী ও এ্যামবুশস্থল থেকে ফিরে যেতে পারত না। সমগ্রিকভাবে এই অভিযোগটি ছিল একটি সফল অভিযান। অভিযান শেষে আনুমানিক ৩৩ জন পাকিস্তান সৈন্য নিহত হয়েছে বলে আমি মুজিব নগরে খবর পাঠাই। রেডিও পাকিস্তান ঢাকা থেকে সেদিনের রাতের খবরে বলা হয় যে শেষরাতে দুই ব্যাটিলিয়ান ভারতীয় সৈন্য পাকিস্তান সীমান্ত ঘাঁটি কামালপুর আক্রমণ করে। স্বল্প সংখ্যক পাকিস্তানী সেনা এই আক্রমণ প্রতিহত করে এবং ভারতীয় সৈন্যদের পেছনে হটিয়ে দেয়। এতে ৩০০ ভারতীয় সেন্য নিহত হয় ও ৬৭ জন পাকিস্তানী সৈন্য শহীদ হয়। এখবর শোনার পর আমরা খুবই উল্লসিত হয়ে উঠি। নিঃসন্দেহে এই অভিযানে আমরা শত্রুকে প্রলুব্ধ করে নির্দিষ্ট স্থানে এনে বিপুল সংখ্যায় হত্যা করতে সক্ষম হয়েছিলাম।

 ১০ই সেপ্টেম্বরের অভিযানটি ও শত্রুকে কামালপুর ঘাঁটি থেকে বের করে আনার একটি সুন্দর কাহিনী। আমি লক্ষ্য করেছি মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের পরপরই পাকিস্তানী সৈন্যরা বেপরোয়া হয়ে উঠতো। বাংলাদেশের ভেতর মুক্তিবাহিনী তাদের কোন ক্ষতিসাধন করতে পারে এই ধারণা তারা স্থানীয় জনসাধারণকে দিতে চাইতো না। তারা সবসময় এ কথা প্রমান চাইত যে, তারা অসীম শক্তির অধিকারী এবং পাকিস্তানকে তারা টিকিয়ে রাখবেই। তাদের এই মানসিকতার জন্য আমি নিশ্চিত ছিলাম যে এবার তারা আমাদের ধানুয়া কামালপুর ও ঘাসীরগ্রাম অবস্থানগুলোয় আক্রমণ করবে। ৭ তারিখ দুপুর থেকে আমরা পাকিস্তানী সৈন্যদের কামালপুর-বকশীগঞ্জ সড়কটি ব্যবহারের অবাধ সুযোগ দিই। এসময় তারা কামালপুরে অবস্থানরত ভীতসন্ত্রস্ত পাকিস্তানী সৈন্যদের সরিয়ে নতুন সৈন্য নিয়ে আসে। আমিও তাই চেয়েছিরাম। ৮ তারিখ বিকাল বেলা মেজর জিয়াউর রহমানের ব্রিগেডিয়ার প্রথম বেঙ্গল রেজিমেণ্টের একটি কোম্পানী মহেন্দ্রগঞ্জে নিয়ে আসি। প্রথম বেঙ্গল রেজিমেণ্টের অধিনায়ক ছিলেন মেজর জিয়াউদ্দিন। ৯ তারিখ ভোর বেলা মেজর জিয়াউদ্দিনকে আমি ধানুয়া কামালপুর ও ঘাসীরগ্রামের অবস্থানে যাই। কামালপুর ঘাটি থেকে বের হয়ে এসে পাকিস্তানী সৈন্যরা ঘাসীর গ্রামের অবস্থানের উপর আক্রমণ চালাবে বলে আমি ধারণা করি। এই অবস্থানকে মজবুত করার জন্যই প্রথম বেঙ্গল রেজিমেণ্টের কোম্পানীটিকে সেখানে রক্ষাব্যূহ তৈরী করার নির্দেশ দিই। কোম্পানী কমাণ্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী (বর্তমানে মেজর ও প্রথম বেঙ্গল রেজিমেণ্টের অধিনায়ক)। ৯ ও ১০ তারিখ রাতে কোম্পানীটি নিজ অবস্থান নেয়। সে রাতেই মুক্তিযোদ্ধারা কামালপুর- বকশীগঞ্জ সড়কে এণ্টি ট্যাংক ও এণ্টি- পারসোনাল মাইন স্থাপন করে। সে সময় থেকে তারা ছোট ছোট দলে সড়কটির পাশে পেট্রোলিংও শুরু করে দেয়। কামালপুরের পূর্ব পাশেও একটি মুক্তিবাহিনী কোম্পনী নিয়োজিত করা হয়। তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয় বকশীগঞ্জ থেকে কোন সাহায্যকারী দল আসলে তাদের বাধা দেয়া এবং কামালপুর থেকে যদি কোন সৈন্য বের হয়ে যায় তাদের হত্যা করা।

 ১০ তারিখ ভোর বেলা থেকেই আমরা কামালপুর ঘাঁটিকে সম্পূর্ণরূপে অবরুদ্ধ করে ফেলি। সরবরাহ বন্ধ, সড়ক যোগাযোগ বন্ধ, শত্রুর জন্য কেবল দুটো পথ খোলা রয়েছে- হয় রাতের অন্ধকারে ছোট ছোট দলে পলায়ন করা অথবা একত্রিতভাবে আমাদের অবস্থানে আক্রমণ করা। দ্বিতীয় সম্ভাবনাটাই ঘটবে বলে আমি ধরে নিয়েছিলাম। এই আক্রমণ আসবে ১০ ও ১১ ই সেপ্টেম্বর রাতে। ১০ তারিখ ভোর বেলা আমি ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী রক্ষাব্যূহ করি। রাতারাতি বেশ কতকগুলো বাংকার তৈরী করে তাদের অবস্থানকে মজবুত করে তুলেছে। তাদের অবস্থানের সামনে থেকেই জলোমাঠাটির শুরু। পানির গভীরতা এক ফুট থেকে তিনফুট। শত্রু একশত গজের মধ্যে আসলে গুলিবর্ষণ করার নির্দেশ দেয়া হয়। আমি স্থিরনিশ্চিত ছিলাম যে এবার আমরা বেশ কিছুসংখক সৈন্য নিধন করতে সক্ষম হবো। এর সাথে সাথে কামালপুর ঘাঁটিও আমাদের দখলে আসতে পারে। শত্রুসৈন্যরা কামালপুর ঘাঁটি থেকে বের হয়ে এসে যখন আক্রমণ চালাবে, তখন সম্পূর্ণ কিংবা আংশিক পরিত্যক্ত কামালপুর ঘাঁটিটি দখলের জন্য বেশ কিছু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধার প্রয়োজন হবে।