অপরিসীম ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিল। তিনদিন কামালপুর থেকে মুক্তিবাহিনীর অবরোধ ভেঙ্গে পাকবাহিনী বের হয়ে যাবার চেষ্টা করলে অনেক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে ৪ঠা ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। কামালপুরের পতন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাকবাহিনী ময়মনসিংহের মেঘালয় সীমান্তের সব এলাকাতে মনোবল হারিয়ে ফেলে এবং দ্রুত পশ্চাদপসারণ করে জামালপুর, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনায় মুক্তিবাহিনীর অভিযোগ করার জন্য সমবেত হয়।
১১ নং সেক্টরের যুদ্ধের পরিকল্পনাঃ নভেম্বর মাসের ১৮ তারিখ ভারতীয় ৯৫ তম মাউণ্টেন ব্রিগেডের ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার, ভারতীয় এবজা সেক্টরের ব্রিগেডিয়ার সাম সিং এবং ভরতীয় পুর্বাঞ্চলীয় কম্যুনিশনের অধিনায়ক মেজর জেনারেল ভগৎ সিং এবং ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক হিসাবে আমার সমন্বয়ে জামালপুর, ময়মনসিংহ নেত্রকোনা প্রভৃতির সম্ভাব্য হামলার পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
স্কোয়াড্রন লীডার হামিদুল্লার নেতৃত্বে রংপুর জেলার গাইবান্ধা দখল করার পরিকল্পনা করা হয়। সাবসেক্টর মহেন্দ্রগঞ্জ এবং পুরাখাশিয়ায় ভারতীয় মাউণ্টেন ব্রিগেডের সহায়তায় জামালপুর দখল করার পরিকল্পনা করা হয়। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী দেওয়ানগঞ্জ থানার হাতিবান্ধায় নিয়োজিত প্রায় ১০০০ মুক্তিযোদ্ধা লেঃ শামসুল আলমের নেতৃত্বে দেওয়ানঞ্জ ও ইসলামপুর হয়ে জামালপুরের পশ্চিমে ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে জামালপুর জগন্নাথগঞ্জ রেল ট্র্যাকে পর্যন্ত অবরোধ করার দায়িত্ব দেয়া হয়। পুরাখাশিয়া সাবসেক্টরের প্রায় ১০০০ মুক্তিযোদ্ধা লেঃ আসাদুজ্জামানের নেতৃত্বে ভায়াডাঙ্গা, নালিতাবাড়ি, নখলা, নুরুান্দ হয়ে জামালপুরের দক্ষিণে জামালপুর- জগন্নাথগঞ্জ রেলসড়ক থেকে জামালপুর টাঙ্গাইল সড়ক পর্যন্ত অবরোধ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। মহেন্দ্রগঞ্জ সাবসেক্টরের অন্য হাজারের একটি দলকে লে: মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে ভারতীয় ৯৫ তম ব্রিগেডের অগ্রভাগে কামালপুর, বক্সিগঞ্জ ও ঝগড়ারচর হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের উত্তর থেকে জামালপুর শহর অবরোধ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। আমার নেতৃত্বে সেক্টরের মূল বাহিনীকে কামালপুর, বক্সিগঞ্জ, শ্রীবর্দি, শেরপর প্রভৃতি এলাকার শত্রু অবরোধ প্রতিহত করে নান্দিনা হয়ে জামালপুরের পূর্ব দিকে অবরোধ করার দায়িত্ব দেয়া হয়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে জামালপুর থেকে ১২ মাইল পূর্বে লাহিড়ীকান্দা এবং কানিল নামক স্থানে ঢাকা, ময়মনসিংহ থেকে রেলপথে এবং সড়কপথে শত্রু রিইনফোর্সমেণ্ট প্রতিহত করার জন্য সার্জেণ্ট ভূঁইয়ার নেতৃত্বে রেল ও সড়ক পথে জামালপুরের সাথে ঢাকা ও ময়মনসিংহের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য প্রায় ৫০০ মুক্তিযোদ্ধা পাঠান হয়। এবং বাকী ১৫০০ মুক্তিযোদ্ধা জামালপুরের দক্ষিন- পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে টাঙ্গাইল সড়ক পর্যন্ত আমার নেতৃত্বে জামালপুর অবরোধ করেন।
জামালপুর অবরোধ সমাপ্ত হয় ৬ই ডিসেম্বর। ৬ই ডিসেম্বর থেকে ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তান বাহিনীর ৩১ বেলুচ রেজিমেণ্ট বহুবার মুক্তিবাহিনীর অবরোধ ভেঙ্গে পালাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় এবং বহু ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে। ১১ ই ডিসেম্বর সকাল ৫৮টার সময় পাকিস্তান বাহিনী মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।
এই যুদ্ধে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল ১০ই ডিসেম্বর বিকাল ৪টার সময় পাকিস্তানী বাহিনীর ৩১তম বেলুচ রেজিমেণ্টের অধিনায়ককে আত্মসমর্পণ করার আহবান জানিয়ে একটি পত্র মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল হক মুন্সীকে দিয়ে একটি সাদা পতাকা হাত নিয়ে পাকিস্তানীদের সদর দপ্তরে পাঠান হয়। উত্তর পাকিস্তানী অধিনায়ক ৭.৬২ চাইনিজ সাবমেশিনগানের একটি বুলেট একটি কাগজ মুড়ে পাঠিয়ে দেয়। তার অর্থ এই যে যুদ্ধই চূড়ান্ত ফয়সালা করবে। সেদিন সন্ধ্যা থেকেই মুক্তিবাহিনী চারদিক থেকে জামালপুর শহরে প্রবেশ করে এবং অন্যদিকে ভারতীয় বিমান বাহিনী থেকে পাকিস্তানী বাহিনীর উপর বোমাবর্ষণ করে পাকিস্তানী বাহিনীর অবস্থা শোচনীয় করে তোলে। তা সত্ত্বেও পাকিস্তান বাহিনী বীর বিক্রমে ১০ই এবং ১১ ই ডিসেম্বর সারা রাতব্যাপী যুদ্ধ চালায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১১ই ডিসেম্বর সকাল ৫ টায় মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। জামালপুর যুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনীর ২১২ জন মৃত্যুবরণ করে, প্রায় ২০০ জন আহত হয় এবং ৫২২ জন আত্মসমর্পণ করে। তাদের অস্ত্রশস্ত্র