এফ- ইউ- পি’র চরম বিশৃংখলা থেকে সামান্য রেহাই পেয়ে প্রথম বেঙ্গল সবেমাত্র অগ্রসর হয়েছে অমনি পাকিস্তানী আর্টিলারীর সেলভো ফায়ার এসে পড়লে, সংগে সংগে আমাদের হতোদ্যম সৈন্যরা মাটিতে শুয়ে পড়ল- শেষ মুহুর্ত বুঝি আর আক্রমণ করা সম্বব হলো না দেখে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীন একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়লেন। একদিকে সমগ্র বাংগালী জাতির মান-ইজ্জতের প্রশ্ন অন্যদিকে দুশো ছেলের জীবন। সালাউদ্দীল তার “ক্ষ্যাপা, দুর্বাসা ছিন্নমস্তা চণ্ডী-রনদা সর্বনাশী, জাহান্নামের আগুরে বসে হাসছে পুষ্পের হাসি’- মারছে লাথির পর লাথি। কারো বা কলার চেপে ধরে অকথ্য ভাষায় গালি দিচ্ছিল- ‘বেশরম’ বেগায়রত, শালা নিমকহারামির দল- আগে বাড়ো। আবার সৈন্যদলের মন চাংগা করার জন্য নিজের অবস্থান জাহির হয়ে যাবে জেনেও পাকবাহিনীকে লক্ষ্যে করে মেগাফে নে উর্দুতে বলেছিল, আভিতক ওয়াকত হায়, শালালোকে সারেণ্ডার করো। নেহীতো জিন্দা নেহি ছোড়েংগা। “তার পরের ইতিহাস প্রতিটি বাংগালীর প্রতিটি বাংগালীর গৌগালীর গৌরবের ইতিহাস। এ যেন শুধুমাত্র ইতিহাস নয়, মুক্তিকামী মানুষের প্রালবন্যার ইতিহাস। বাংগালী সৈন্যরা তখন ছুটছে ঝড়ের মতো করতালি দিয়ে স্বর্গমর্ত্য করতলে। বঙ্গোপসাগরের উত্তাল তরঙ্গমালার মত প্রথম ইষ্ট বেঙ্গল মূহুর্তের মধ্যে ভাসিয়ে দিল পাক বাহিনীর ডিফেন্সের প্রথম সারির বাংকারগুলো। সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মত গুরুগর্জন করে সিনিয়র টাইগার ‘জয় বাংলা আর ‘আকবর ধ্বনিতে প্রকম্পিত করে তুললো যুদ্ধের ময়দানকে। বাংকার অতিক্রম করে বিশ-পটিশটা ছেলে কমিউনিটি সেণ্টার ঢুকে পড়লো। তাদের মাত্র দু- একজন আহত অবস্থায় ফেরত আসতে পেরেছিল আর বাকি সবাই হাতাহাতি যুদ্ধে শাহাদৎ বরণ। প্রচণ্ডভাবে তখন হাতাহাতি যুদ্ধ চলছে। বাঘের থাবাকে য়ত্রতত্র ভূপাতিত পাকসৈন্যরা। পিছনে কখন আমাদের পক্ষের লাশ আসা শুরু হয়ে গেছে। কর্নেল জিয়া তখন কলছেন, আই উইল একসেপ্ট নাইনটি ফাইভ পারসেণ্ট ক্যাজুয়েলটি বাট... দেম আউট মঈন। আহত ক্ষতবিক্ষত জোয়ানরা বলেছে, ‘স্যার-নিয়ে এলেন কেন? আর সামান্য বাকী- কি হত আমি না হয় মরে যেতাম। গর্বে বুক ফুলে উঠছিল। পিছনের উচু পাহাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা দর্শকেরাও বুঝতে পারছিলেন বাঙ্গালীরা শুধু বসে বসে (এমনকি না খেয়ে) কবিতা লিখে কিংবা গাল-গল্প করে আর শ্লোগান দিয়ে ভাবালুতার মাঝে দিন কাটায় না। যুদ্ধও করতে জানে বৈকি। আজকে শুধু আফসোস হচ্ছে যে, আজকের পেপার-টাইগার যদি সেদিন যুদ্ধের ময়দানে থাকতেন তবে সম্ভবত আজ আর তারা আমাদেরকে ‘খোদার খাসী’ রলার দুঃসাহস প্রকাশ করতেন না। ক্যাপ্টন সালাউদ্দীনের গায়ে তখনও সেই রিলিফের সাদা শার্টটা ছিল। মহানগরীর নিউ মার্কেটে গিয়ে মার্কেটিং করার অবসর তার ছিল না, না ছিল সংগতি কিংবা তেমন নীচু মনোবৃত্তি। তবে হ্যাঁ, বন্য পশুদের মত আমরা জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরেছি। তাই বুঝি লুঙ্গি মালকোচা বেঁধে সিভিল অফিসার তৌফিক এলাহি যশোর রণাঙ্গনকে কাঁপিয়ে রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন।
এদিকে মাইন-ফিণ্ডে ফেসে যাওয়া সুবেদার হাই-এর প্লাটুনের ডানে অবস্থানরত ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীন বুঝতে পারলেন যে, শক্ররা মাইন-ফিল্ডের পেছনের বাংকারগুলো ছেড়ে দিয়ে পেছনে সেকেণ্ড লাইনে সরে গিয়ে কাউণ্টার এ্যাটাকের প্রস্ততি নিচ্ছে। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীন মেগাফোনে হাইকে প্লাটুনের নিয়ে ডানে যেতে বললেন। প্রথম আক্রমণ শুরুকালে সুবেদার হাই-এর লোকসংখ্যা ছিল ৪০ জন। কিন্তু লক্ষ্যে পোঁছা পর্যন্ত সংখ্যা দাঁড়াল ১৫ হতে ২০ জনে। এদিকে মাইনের আঘাতে নায়েক শফির হাত উড়ে গেল আর (মাটিতে শুয়ে পড়া)। সালাউদ্দীন ধমকে উঠলো বেটা-স্যার করে চিৎকার করিস না, মক্ররা আমার অবস্থান টের পেয়ে যাবে। চিন্তা করিস না তুই বেটা আমার কাছে এসে দাঁড়া, গুলি লাগবে না, ইয়াহিয়া খান আজও আমার জন্য গুলি বানাতে পারেনি। দুদিকে বৃষ্টির মত গুলির মাঝে দাঁড়িয়ে একাথা বলা চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। তাই বুঝি আজও ১ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট কেদে কেঁদে খুঁজে বেড়াচ্ছে তাদের প্রাণপ্রিয় সালাইদিনকে। দ্বিতীয় বার মেগাফোনে হাই’ বলার সাথে সাথে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীনের সামনে ২/৩টি বোমা এসে পড়লো। মুহুর্তের মধ্যে সালাউদ্দিন ধরাশায়ী হলেন। তার দেহটা প্রথম বামে, পরে আধা ডানে ও শেষ দড়াম করে পেছনের দিকে পড়ে গেল। আশপাশের জোয়ানরা ছুটে আসে, ‘স্যার, কলেমা পড়েন। কিন্তু বাংলার একান্ত গৌরব সালাউদ্দীন উত্তর দিল, “আমার কলেমা পড়ার দরকার নেই। খোদার কসম, যে পেছনে হটবি তাকে গুলি করবো।’ তারপর বিড় বিড়