বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৫০৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দশম খণ্ড
481

করে আবার বলে উঠলো, 'মরতে হয় এদেরকে মেরে মর-বাংলাদেশের মাটিতে মর।' এমন মরণ দুনিয়ার ইতিহাসে যে বিরল তা হয় তবে এ মৃত্যুতে আছে আনন্দ, আছে গর্ব। উঁচু মাটির টিবিতে পড়ে থাকা সালাউদ্দীনের লাশটা ২/৩ জন জোয়ান শত্রুর এলাকা থেকে টেনে আনতে চেষ্টা করলো, কিন্তু ব্যর্থ হয়ে সকলেই মৃতুবরণ করে। পরিশেষে একটি বিহারী ছেলে ৮টি গুলি খেয়েও শেষবারের মত চেষ্টা করে নিজে গুরতরভাবে আহত হয় এবং লাশটি আনতে ব্যর্থ হয়। সালাউদ্দীনের গায়ে তখনও সেই সাদা শার্টটা ছিল যা তার খুলে ফেলার কথা ছিল, কারণ, সাদা শার্ট রাত্রিবেলায় বেশী দেখা যায়। শেষ পর্যন্ত ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীনের ঘড়ি, স্টেন ও অন্যান্য কাগজ নিয়ে আসা হয়।

 ওদিক ক্যাপ্টেন হাফিজ বেঁচে গেলেন অলৌকিভাবে। হাতের স্টেন তোপের মুখে উড়ে গেলেও সামান্য আহত হয় বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ফুটবলার বেঁচে গেলেন, কিন্তু ৬০০ গজ পিছনে এফ-ইউ-পি তত্ত্বাবধানে কর্মরত লেঃ মান্নান ঊরুতে গুলি খেয়ে গুরুতরভাবে আহত হলেন, যদিও বা একই জায়গায় একই ভাবে ফ্লাইং অফিসার লিয়াকতও শুয়ে ছিলেন। অন্যদিকে আহত ক্যাপ্টেন হাফিজকে উদ্ধারকল্পে ল্যান্স নায়েক রবিউল ছুটলো শত্রু অভিমুখে। কয়েক কদম যাওয়ার পর দুই হাতেই গুলি এসে লাগল, তথাপি তার প্রাণপ্রিয় তথা বাংলাদেশের অমূল্য রত্ন ক্যাপ্টেন হাফিজকে উদ্ধার করার সংকল্প থেকে এতটুকু টলাতে পারেনি। যথাস্থানে পৌঁছে দেখে হাফিজকে অন্য কেউ নিয়ে গেছে। পড়ে থাকা অয়ারলেস ও রকেট লাঞ্চার উঠাবার সময় রবিউলের বুকে গুলি লাগল। রবিউল মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। পাশের জোয়ান সাহায্যের ভয়ে পাশ কেটে চলে গেল। রাগে-দুঃখে রবিউল গ্রেনেডটা হাতে নিয়ে (উদ্দেশ্য, বন্দী হবে না) জীবনের আশা ত্যাগ করে নিকটবর্তী আখক্ষেতের দিকে দিল ভোঁ দৌড়। বৃষ্টির মত শত্রুর গুলি আসছিল। কিন্তু আশ্চর্য, রবিউলের গায়ে লাগল না। কোনমতে টেনে-হেঁচড়ে আখক্ষেতে গিয়ে পৌঁছতেই রবিউলের প্রতীতি জন্মালো সে সহজে মরছে না, আর অন্যের সাহায্য ব্যতীতই সে বাঁচতে পারবে। বাঁ হাত থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। ডান হাতের হাড়টি বের হয়ে আছে। নাকে মুখে রক্তের ছোপ। এ অবস্থায় পালিয়ে যেতে দেখে এগিয়ে এসেছিল গ্রামের গৃহবধূরা, যদিও গৃহস্বামীরা প্রত্যাশী নয়। তাই গৃহবধূরা, যদিও গৃহস্বামীরা দরজায় দাঁড়িয়ে ইতস্তত করছিল। নিজের সাথী যখন মুখ ফিরিয়ে চলে গেল তখন সে আর কারো সাহায্য প্রত্যাশী নয়। তাই গৃহবধূদের হাত ছাড়িয়ে সে এগিয়ে যেতে চেষ্টা করলো কিন্তু পরের ইতিহাস আজও তার কাছে ঝাপসা হয়ে আছে। তার বিশ্বাস দুই রমণীর কাঁধে ভর দিয়ে সে এফ-ইউ-পি এরিয়া পর্যন্ত পৌঁছবে। এদিকে সালাউদ্দীনের মৃত্যুর পর আমাদের সৈন্যদল ছত্রভংগ হয়ে গেলেও সেই অবস্থায় ছোট ছোট গ্রুপে ওরা শত্রুর বাংকারগুলোর উপর আঘাতের পর আঘাত হানতে থাকে। বেলা তখন ৭টা বাজে। অযথা লোকক্ষয় না করে উইথড্র করা শ্রেয় জেনেও মেজর (বর্তমানে লেঃ কর্নেল) মঈন তার সৈন্যদলকে কিছুতেই পশ্চাদপসরণ করাতে পারছিলেন না। আমাদের আর শত্রুর লাশে কমিউনিটি সেণ্টার ভরে গিয়েছে। শেষ পর্যন্ত বেলা সাড়ে কিংবা নিখোঁজ আর দুইজন অফিসারসহ ৬৬ জন আহত হয়। শত্রুদের লাশ তিনটা ট্রাক বোঝাই করে নিয়ে যেতে গ্রামের লোকেরা দেখেছে। পরদিন হেলিকপ্টারে পাক বাহিনীর উচ্চপদস্থ অফিসাররা, সম্ভবতঃ জি-ও-সি আসেন কামালপুর পরিদর্শন করতে। বলাবাহুল্য, ঐ দিনই পাক বেচতারে কামালপুর যুদ্ধের ভয়াবহ বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয় যে, প্রায় ৪০০ দুষ্কৃতকারী নিহত হয়েছে। এক অপারেশনে এত বড়সংখ্যক দুষ্কৃতকারীর নিহত হওয়ার সংবাদ ইয়াহিয়ার বেতারে আর কখনো প্রচার করা হয়নি।

 ফলাফলঃ বাংকারে বসে থাকা খানসেনাদের মনে ভীতি সঞ্চার করাই এ যুদ্ধের সবচেয়ে বড় সাফল্য। এ যুদ্ধে প্রমাণিত হলো বাঙ্গালীরা দূর থেকেই আর পালিয়ে যাবে না বরং বাংকার থেকে খানসেনা তাড়ানোই তাদের উদ্দেশ্য। তাই বুঝি এই আক্রমণের পর থেকে খানসেনারা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট তথা কামালপুরের নাম শুনলেই আঁতকে উঠত। তখনকার দিনে পাক শিবিরে বন্দী মেজর আজিজের ভাষায় বলতে হয় পাকিস্তানীদের নিজেদের মতে কামালপুর হলো পাকসৈন্যদের মরণঘাঁটি। জিজ্ঞাসাবাদের সময় আজিজকে জিজ্ঞাসা করা হতো, “হয়ার ইজ ধানিয়া কামালপুর কিংবা হয়ার ইজ উত্তর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট”। কথা প্রসংগে সেই জুলাই-আগস্ট (১৯৭১)