পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৫১০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
485

পড়ছিল। অবশ্য পূর্বাহ্নে আর্টিলারীর কর্মক্ষমতা সম্বন্ধে সন্দিহান হলে কিংবা এত নিম্নমানের হতে পারে এ ধারণা থাকলে আমি হয়ত ডাইনে হালছটি গ্রামের শালবনকে এফ-ইউ-পি বানাতাম। হালটি গ্রামের শালবনটি শত্রশিবির থেকে মাত্র তিনশ’গজ দূরে ছিল। কিন্তু যেহেতু আমাদের আক্রমণের বেশ কিছুদিন আগে ঐ শালবনকে এফ-ইউ-পি বানিয়ে এফ-এফ কোম্পানী বি-ও-পি'র উপর আক্রমণ করেছিল, তাই আমি ঐ শালবনটিকে এফ-ইউ-পি বানাইনি। অন্যদিকে পূর্বদিন আমার পরিকল্পনা ছিল সামনের নালাকে এফ-ইউ-পি বানিয়ে আর্টিলারীর “ফায়ার অন কল রেখে (দরকার মহত ব্যবহার করা) আক্রমণ করা। তাতে করে রাতের আধারে শত্রর অজান্তে আমরা শত্রশিবিরের ২/৩ শ’ গজ ভিতরে পৌছে যেতাম আর নিজস্ব আর-আর ও মেশিনগান দিয়ে শত্রকে আচম্বিতে ঘায়েল করে শত্রর ব্যুহ অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারতাম বলে আমার বিশ্বাস ছিল। আর বিশেষ দরকার মত আর্টিলার সাপোর্ট তো ছিলই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অবস্থার চাপে পূর্ব পরিকল্পনা বদল করে প্রি-এইচ আওয়ার (আক্রমণের পূর্বাহ্নে) গোলাবর্ষণের কার্যক্রম নিতে বাধ্য হলাম। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস, যুদ্ধের আগেই এফ-ইউ-পিতে নিজেদের আর্টিলারীর এই দু-তিনটি রাউণ্ড এসে পড়াতে আমার ছয়টি ছেলে ঘচনাস্থলে গুরুতর রুপে আহত হয়। ফলে পুরা প্লাটুন আহতদের শুশ্রুষার নামে এফ-ইউ-পিতেই থেকে যায়। এতে যথেষ্ট শোরগোলও হয়। অপরদিকে প্রচণ্ড গোলাগুলির মাঝে আমাদের আর্টিলারী গর্জে ওঠার মিনিট খানেকে ভিতর পাকিস্তানী আটিলারী গর্জে ওঠে। একবার মাটিতে শুয়ে পড়ে তারপর আবার দাঁড়িয়ে অগ্রসর হওয়া যথেষ্ট সাহসের কাজ বৈকি-বিশেষ করে আমার দুই কোম্পানীর জন্য। কারণ আমার দুই কোম্পানীতে (৮তম ইষ্ট বেঙ্গল) দুশো জনের মধ্যে তখন মাত্র ১০ জন সামরিক বাহিনীর লোক, গোটা আটেক ই-পি-আর এবং দু তিনজন পুলিশের লোক ছাড়া বাকী সবাই সাতদিনের ট্রেনিং প্রাপ্ত গ্রামবাংলার একান্ত সাধারণ মানুষ। প্রি-এইচ আওয়ার গোলাবর্ষণের সাথে সাথে আমার ডানে অবস্থিত মেশিনগান ও আর -আর প্রচণ্ডভাবে গর্জে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে হালছটি গ্রাম থেকে ই-পি-আর’এর প্লাটুনটি ভাঁওতা দেয়ার জন্য আক্রমণের ব্যুহ রচনা করে শত্রদের ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়া দিল। এই কার্যক্রমগুলো অত্যন্ত সুষ্ঠু ও সাবলীল গতিতে হতে থাকে। ই-পি-আর’এর আক্রমণ চলাকালীনই আমরা চুপি চুপি এক্সটেনডেড লাইন ফরমেশন করে পায়ে পায়ে এগুতে থাকি। এ অবস্থায় সুবেদার জালাল যথেষ্ট দৌড়াদৌড়ি করলেও পরবর্তীকালে তার আর সাক্ষাৎ পাইনি। এফ-ইউ-পি ছাড়ার সাথে সাথে একটি ছেলে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে উঠলো, “স্যার বা দিক থেকে গুলি আসছে যে” -ভাবখানা এই গুলি তার পিছু ধাওয়া করছে। হাসি পেলেও চিৎকার করে উঠলাম- “বেটা গুলি আসবে না তো বৃষ্টিধারা আসবে?” ৫০০ গজ আগে নালার কাছে পৌছে শুধু ২" মর্টারওয়ালাদেরকে নালার পাড়কে আড়াল রেখে ৩০০ গজ আগে শত্রশিবিরের উপর ফায়ার করার নির্দেশ দিলাম। এই নির্দেশ না দিলেই যেন ভাল হতো, কারণ আমার এই নির্দেশের সুযোগ আমার স্বল্পট্রেনিংপ্রাপ্ত সৈনিকরা নালাতে আড়াল নিয়ে নেয়, তাতে কমাণ্ডার কণ্ট্রোল একেবারে শিথিল হয়ে পড়ে। নায়েক সুবেদার কাদের ও বাচ্চুর অধীনে ৫ ও ৬ নং প্লাটুন বি-ও-পি’র গেটের ভিতর দিয়ে প্রবেশ করার কথা ছিল, কিন্তু তারাও নালার ভেতরে আড়াল নিয়ে মাথা নিচু করে আন্দাজে ফায়ার করতে শুরু করে। সম্ভবতঃ এই জন্যই এফ-ইউ-পি ত্যাগ করার পর ফায়ার এণ্ড মুভ পদ্ধতিতে আক্রমণ করা মিলিটারী একাডেমীতে (পাকিস্তান) বিতর্কের বস্ত ছিল এবং প্রায়ই বলা হতো এফ-ইউ-পি ছাড়ার পর ডোণ্ট গো টু দি গ্রাউণ্ড এগেইন নালাতে আমার সৈন্যদের এমন কাণ্ড দেখে শত্রশিবিরের নিকটবর্তী এসেও আমি চিৎকার না করে পারিনি, এমন কি কাউকে কাউকে পর্যন্ত লাথিও মেরেছিলাম। শেষ পর্যন্ত উপায়ান্তর না দেখে করার চেপে ধরে আমি জোর করে আগে পাঠাতে চেষ্টা করি। আমার বামে হাবিলদার নাসির অত্যন্ত সাহসের সাথে ক্ষিপ্তগতিতে এগুতে থাকে এবং আমি নিজে নায়েক সিরাজকে সাথে করে ডানে বাংকারের দিকে এগুতে থাকি। আমাদের এই মনোবল দেখে তখন পলায়নরত। ইতিমধ্যে আমরা এসল্ট লাইন ফর্ম করি এবং সঙ্গে সঙ্গে চার্জ বলে হুংকার দিই এবং পর মুহুর্তে ইয়া আলী বলে আমার সৈন্যরা সংগীন উচু করে বেয়নেট চার্জের জন্য রীতিমত দৌড়াতে শুরু করে। এদের উত্তেজনাকে বাড়াবার জন্য নায়েক সুবেদার মুসলিম নারায়ে তোলে। আনন্দের আতিশয্যে আমার সিগনালম্যান আয়ারলেস সেট আমার সামনে এনে ধরলে আমি ধমকে