পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৫১১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
486

উঠলাম 'তুমি নিজেই যা পার বলে পাঠাও'। পিছু পিছু সে অয়ারলেসে জোরের সংগে বলে বেড়াচ্ছিল, “হয়ে গেছে, আর একটু বাকি.. বাংকারে বাংকারে যুদ্ধ জয় হচ্ছে”....ইত্যাদি। ঠিক এমন সময় শত্রুদের আর্টিলারীর শেলভো ফায়ার (এয়ার ব্রাস্ট) এসে পড়লো আমাদের উপর। সংগে সংগে বেশ কয়েকজন ঢলে পড়ল, যার ভেতর সম্ভবতঃ হাবিলদার নাসিরও ছিল। আমাদের সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। আমার ডান পায়ে এসে একটা শেল লাগল, আঘাতটার গুরুত্ব উপলদ্ধি করার আগেই জোশের সাথে এগিয়ে গেলাম আরো পঞ্চাশ গজ। শত্রবাংকার মাত্র পাঁচগজ বাকি। আমাদের গুটিকতক ছেলে তখন পলায়নরত শত্রুদেরকে মারছে। কেউ কেউ মাইন-ফিল্ডে ফেঁসে গিয়ে শত্রুর মাইনে উড়ে যাচ্ছে। কেউবা শত্রুর গুলি খেয়ে পড়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় অনার্সের ছাত্র শামসুল আলম মাইন কিংবা শত্রুর তোপের মুখে উড়ে গেল। ঐ বিশ-পঁচিশটা ছেলের মন চাংগা রাখার জন্য জোরে জোরে চিৎকার করে উঠলাম- “বি-ও-পি একেবারে তছনছ হয়ে গেছে। আগে অগ্রসর হও” -যদিওবা বি-ও-পি'র মাটির দেওয়াল আগের মতই ঠিক খাড়া ছিল। এমন সময় আমার বাম পায়ে বাঁশের কঞ্চি বিধলো, আমি পড়ে গেলাম। সম্ভবতঃ পড়ে যাওয়ার আগের মুহূর্তে আহত এক খানসেনা এলো সংগীন নিয়ে। বাচ্চা ছেলে লালাম (অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র এবং এক সুবেদার মেজরের ছেলে) আগেই খতম করে দিল খানসেনাকে। এদিকে যারা মাথা নিচু করে আন্দাজে ফায়ার করছিল তাদের ফায়ারে আমাদের দুটি ছেলে জখম হল'। করার কিছুই নেই তখন। এর আগে এফ-ইউ-পি থেকে এডভান্স করাকালীন নালাতে অবস্থান করা কালে অমন মাথা নিচু করে আন্দাজে ফায়ার করার জন্য আমি একটি ছেলের কাছ থেকে রাইফেল কেড়ে নিয়ে পেছনে পাঠিয়ে দিই। মাটিতে পড়ে গিয়ে আমি দুটি ধাবমান শত্রুকে গুলি করে ডানদিকে বাংকারে অবস্থানরত শত্রুসেনাকে গুলি করার জন্য বিহারী ছেলে হানিফকে ঘন ঘন নির্দেশ দিচ্ছিলাম। অবশ্য হানিফ তখন ভীষণভাবে অনুরোধ করছিল। “স্যার, আব পিছে চলে যাইয়ে, ম্যায় কভারিং দে রাহাহু”। বলা বাহুল্য, বিহারী ছেলে হানিফ ছিল আমার ব্যক্তিগত প্রহরী। বরিশালের এক বাংগালী মেয়েকে বিয়ে করেছিল হানিফ। বেশ কয়েকটা অপারেশন করার পরেও সন্দিহান হয়ে মুক্তিবাহিনী তাকে গ্রেফতার করে। বন্দীশিবিরে স্পষ্ট বাংলায় সে আমাকে বলল, “স্যার, আমি বেঈমান না, একটা চান্স দিন, জান দিয়ে প্রমাণ করবো।” পিঠ চাপড়িয়ে আমি বললাম- “হানিফ আজ থেকে তুমি আমার পারসোনাল গার্ড। পারবে?” “স্যার, আমার জান থাকতে আপনার গায়ে গুলি লাগবে না” -প্রত্যয় ভরা কণ্ঠে উত্তর দিয়েছিল হানিফ।

 সত্যি সে জীবিত থাকাকালীন আমার পায়ে গুলি লাগেনি (যদিও শেল লেগেছে)। হানিফকে দ্বিতীয়বার নির্দেশ দেবার আগেই হিস শব্দ হল, হানিফ ঢলে পড়ল, মনে হয় ওর মাথায় গুলি লেগেছিল। তার মাথায় স্টীল হেলমেট ছিল না। ক্রল করে ওর হ্যাবারসেকে ধাক্কা দিয়ে ক্ষীণস্বরে বলে উঠলাম 'হানিফ’- কোন সাড়া আসল না। প্রাণটা কেঁদে উঠল। সাথে সাথে শত্রুর গুলিতে পাশের মাটি উড়ে গেল। বুঝতে পারলাম শত্রু আমাকে দেখে ফেলেছে। সাইড রোল করে সরে যাওয়ার চেষ্টা করাকালীন বামদিক থেকে একটা গুলি এসে আমার ডানহাতের কনুইতে লাগল। ঝাঁ করে যেন বিদ্যুৎ প্রবাহিত হল, হাতের ষ্টেনটা ছিটকে পড়ল। বাঁ হাতে তা কুড়িয়ে নিলাম। কব্জিটা বেঁকে নিচের দিকে ঝুঁকে পড়লো। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। ফিল্ড- ড্রেসিংটা বের করব-একঝাঁক গুলি এসে পাশের জমির আইলটা উড়িয়ে দিল। বুঝতে পারলাম শত্রুর পাঁচগজের ভিতর আর থাকা সম্ভব নয়। আমার দু'ধারে শুধু লাশ আর লাশ। কারণ, এর আগের মুহূর্তে এস-ও-এস (সেইভ আওয়ার সোল) এয়ার ব্রাস্ট, আর্টিলারী ফায়ারে আমাদের যে ৮/১০ জন লোক শত্রুর বাংকারে ঢুকে পড়েছিলো তার ধরাশায়ী হলো। তার মধ্যে নায়েক সিরাজ এবং পুলিশের ল্যান্স নায়েক সুজা মিয়াও ছিল। পাশে তাকিয়ে দেখি একটি কচি ছেলের লাশ। ছেলেটি কিছুক্ষণ আগে শত্রুর গুলিতে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে শত্রুর ডান বাংকার এড়িয়ে কোনাকুনি আরো ডানে অধিকতর নিরাপদ স্থানে হালছটি গ্রামের দিকে যেতে চেষ্টা করছিল।

 শত্রুশিবিরে পাঁচ গজের ভিতর থেকে বের হওয়ার জন্য ফিল্ড-ড্রেসিং আর বের না করে সাইড রোল শুরু করলাম। উদ্দেশ্য, ডানের ঢালু জমি দিয়ে অধিকতর নিরাপদ রাস্তাতে পশ্চাদপসরণ করা। কিছুক্ষণ সাইড রোল করার পর তাকিয়ে দেখি আসলে ডানে না গিয়ে আমি কোনাকুনি শত্রু শিবিরের দিকে যাচ্ছি। মাথাটা ঠাঙা