পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৫১৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
492

 প্রথম বেঙ্গল রেজিমেণ্টে তখনি কমাণ্ডিং অফিসার ছিলেন তদানীন্তন মেজর (বর্তমানে কর্নেল) মাঈনুল হোসেন চৌধুরী। এই রেজিমেণ্টাটি তদানীন্তন পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে সিনিয়র টাইগার হিসাবে পরিচিত ছিল। সিনিয়র টাইগার তখন কামালপুর অপারেশনে ব্যস্ত ছিল। এই ব্যস্ততার মধ্যে আমি আমার দায়িত্ব ভার গ্রহন করি। যেহেতু প্রথম বঙ্গেল রেজিমেণ্টের এলাকাভিত্তিক দায়িত্ব ছিল ময়মনসিংহ থেকে রংপুর পর্যন্ত সেহেতু আমাকে রংপুরের কোদালকাটি নামক স্থানে শত্রুর উপর হামলা চালাবার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, আমার সাথে সাথে মেজর জিয়াউদ্দীন ব্যাটালিয়ানের নতুন কমাণ্ডিং অফিসার হিসাবে দায়িত্ব গ্রহন করেন। তার নির্দেশ আমি কোদাল মাটিতে সাময়িকভাবে ডিফেন্স স্থাপন করি। পরদিন পুরা এলাকা দেখার পর রাত্রি প্রায় ২ টার সময় শত্রুঘাঁটি পুরোপুরি ঘেরাও করে ফেলি। শত্রুরা চারদিক অবরুদ্ধ হবার পুর আমাদের উপর আক্রমণ চালায়। এ সময় এক প্লাটুনের উপর সাংঘাতিকভাবে আক্রমণ চলে এবং তারা প্রায় আমার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সাথে সাথে আমি শত্রুর উপর প্রতি-আক্রমণ চালাই। আক্রমণের ফাঁকে প্রায় হাতাহাতি চলতে থাকে। আক্রমণের ফলে উভয় পক্ষে যথেষ্ট হতাহতের পর শত্রুপিছু হটতে বাধ্য হয়। শত্রু উপায়ন্তর না দেখে নিরীহ গ্রামবাসীর উপর তাদের জিঘাংসা চরিতার্থ করে।

 ধলাই অপারেশন(২৮শে অক্টোবর, ১৯৭১): ধালাই সিলেট জেলার একটি অংশ। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে ধালাই রণাঙ্গন প্রখ্যাত ছিল। এই অপারেশনটা চালাবার জন্য প্রথম রেজিমেণ্টকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। যদিও এটি ছিল পাক-বাহিনীর দুর্ভেদ্য ঘাঁটি তথাপি প্রথম বেঙ্গল রেচিমেণ্টের এ-কোম্পানী কমাণ্ডার ক্যাপ্টেন মাহবুব (শহীদ) তার কোম্পনী নিয়ে একবার শত্রুর উপর আঘাত হানেন। কিন্তু স্বপক্ষের বেশ কিছু আহত সৈনিক নিয়ে তাকে ফিরে আসতে হয়। এদের মধ্যে যারা মারাত্মকভাবে আহত হন তাদের মধ্যে প্রথম দুইজন হচ্ছেন সুবেদার ইব্রাহীম এবং অন্যজন হচ্ছেন রকেট লাঞ্চার-এর নাম্বার ওয়ান হাওয়ালদার সোবহান। এদের দু'জনকেই ঘটনাস্থল থেকে হেলিকপ্টারে মুক্তিবাহিনী বেইস হসপিটালে পাঠানো হয়। এরপর আমি সফলতার সঙ্গে খেজুরীচর টারগেটকে দখল করার পর তদানীন্তর ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার ধালাই দখল করার ভার আমার উপর ন্যস্ত করেন। যদিও আমি জানতাম এই রণাঙ্গন থেকে ফিরে আসার সম্ভাবনা খুবই কম ছিল তথাপি দৃঢ়তার সঙ্গে আমাকে দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে একদিন ক্যাপ্টেন (বর্তমানে মেজর) হাফিজউদ্দিন ঠাট্টা করে বলেছিলেনঃ তোমার নতুন যে প্যাণ্টটা তৈরী করেছ তা অন্ততঃ একবার পরে যাও। নতুবা মরে গেলেও হয়ত দুঃখ থেকে যাবে।

 ১৯৭১ সালের ২৭শে অক্টোবর রণাঙ্গনের দামামা বেজে ওঠে। যেহেতু পুরা ব্যাটালিয়ন এতে অংশগ্রহণ করেছিল সেহেতু পরিকল্পনা অনুযায়ী 'এ' এবং 'ডি' কোম্পানী ২৭শে অক্টোবর রণাঙ্গনের দিকে যাত্রা করে। তাদের দায়িত্ব ছিল পেছন থেকে যাতে শত্রু যোগাযোগ করতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখা এবং শত্রু যাতে সৈন্য এবং রসদ-সরঞ্জামাদি পরিবহন করতে না পারে তা নিশ্চিত করা। ধালাই এলাকায় বেশ এক অংশ জুড়ে পাকিস্তানী সৈন্য মোতায়েন করা হয়েছিল। এমনকি প্রত্যেকটা বাংকার কংক্রিটে নির্মাণ করা হয়েছিল। বাংকারগুলো এমন ধরনের ছিল যে এর ভেতর থেকে বের হবার প্রয়োজন খুব একটা হতো না। কারণ রসদ সরঞ্জামাদি প্রচুর পরিমাণে মওজুত থাকত। রণকৌশলের দিক থেকে সন্মুখ সমরে ঝাঁপিয়ে পড়াছিল আমার পরিকল্পনা। সেদিক থেকে বিচার করে ২৭শে অক্টোবর সকাল ৪টার সময় আমি কোম্পানী নিয়ে অগ্রসর হই। বলাবাহুল্য, ক্যাপ্টেন নুর প্রথমবারের মত সেদিন আমার সাথে যোগ দেন। তিনি আমার এক নম্বর প্লাটুন নিয়ে বাম দিক থেকে অগ্রসর হতে থাকেন এবং আমি দুই নম্বর ও তিন নম্বর প্লাটুন নিয়ে ডান দিক দিয়ে অগ্রসর হতে থাকি। টারগেট থেকে যখন আমি প্রায় ৫০ গজ দুরে ছিলাম তখন কিছু গোলগুলির আওয়াজ শুনি। অয়ারলেসে জানতে পারলাম যে ক্যাপ্টেন নুর প্রায় শত্রু ঘাঁটির ভিতরে ঢুকে গেছে। এই সময় আমি সুযোগ বুঝে শত্রুর উপর আক্রমণ চালাই। এখন শুধু বুলেটের আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না। শত্রু প্রত্যক্ষভাবে আমার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। অবশেয়ে শুক্রর অধিকাংশ আমার উপর নিয়োজিত হয়। সুতরাং এ সময়ে ক্যাপ্টেন বেশ হতাহত হয়। তিনি একটু পিছে এসে ডিফেন্স নেন এবং আহতদেরকে পেছনে