ভালভাবে রেকি করি। ২২শে নভেম্বর সকালে আমি 'বি' কোম্পানী নিয়ে আর্টিলারীর সাহায্যে চারগ্রাম শত্রু ঘাঁটি আক্রমণ করি। সারাদিন প্রচণ্ড যুদ্ধের পর আমরা উক্ত ঘাঁটি দখল করে নেই। শত্রুপক্ষের প্রায় ৩০ জন হতাহত হত এবং কয়েকজনকে আমরা জীবিত অবস্থায় বন্দী করি। এ ঘাঁটি থেকে আমরা প্রচুর পরিমাণ 'অস্ত্রশস্ত্র গোলাগুলি, খাদ্যদ্রব্য এবং অন্যান্য যুদ্ধের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম দখল করি। এ আক্রমণে সাফল্য লাভ করাতে আমাদের সৈন্যদের মনোবল অনেক গুনে বেড়ে যায়। এ যুদ্ধে 'বি' কোম্পানী অত্যন্ত সাহস এবং রণকৌশল প্রদর্শন করে। একই দিনে 'সি' কোম্পানী ক্যাপ্টেন নূরের নেতৃত্বে আটগ্রাম ব্রীজ আক্রমণ করে এবং দখল করে নেয়। এ স্থানেও আমরা প্রচুর পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাগুলি দখল করতে সক্ষম হই। এভাবে আমরা চারগ্রাম এবং আটগ্রাম এলাকাকে সম্পুর্ণ রূপে শত্রুমুক্ত করি। এ যুদ্ধে বীরত্বের পরিচয়স্বরুপ নিম্নলিখিত সৈন্যগণকে সাহসিকতার পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। যথাক্রমে তাঁরা হলেনঃ (১) ক্যাপ্টেন নূর চৌধুরী (বীর বিক্রম), (২) নায়েক সুবেদার আবুল হাশেম (বীরবিক্রম), (৩) নায়েক সুবেদার মোঃ ইব্রাহিম (বীরবিক্রম)। পাকিস্তানী সৈন্যরা প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে সিলেটের দিকে পশ্চাৎপদসরন করে। আমরা মেজর জিয়াউদ্দিনের সুযোগ্য নেতৃত্বে পাকিস্তানী সৈন্যদের অনুসরন করি। শত্রুরা পলায়নের সময় বেশ কয়েকটি পুল উড়িয়ে দেয় এবং রাস্তাঘাটে বহু মাইন পুঁতে রাখে। মাইন পোঁতা রাস্তা পরিস্কার করতে করতে তাদের পশ্চাৎ যেতে থাকি এবং গৌরিপুর এলাকায় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেই।
২৮শে নভেম্বরঃ এদিন ভোরে পাকিস্তানী ৩১ তম পাঞ্জাব রেজিমেণ্ট আমাদের ‘এ’ কোম্পানীর পজিশনের উপর আক্রমণ করে। ‘এ’ কোম্পানী অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে তাদের আক্রমণ ব্যর্থ করে দেয়। এ যুদ্ধে শত্রুপক্ষের প্রায় ১০০ জন সৈন্য নিহত হয়। একজন মেজর (মেজর সরোয়ার) এবং একজন ক্যাপ্টেনও নিহত হয়। আমাদের পক্ষে ১০/১১ জন শহীদ হয় এবং প্রায় ২০ জন যোদ্ধা আহত হয়। সমস্ত যুদ্ধক্ষেত্র শত্রুপক্ষের মরা লাশে ভরে যায়। “এ” কোম্পানী কমাণ্ডার ক্যাপ্টেন মাহবুব বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে এই যুদ্ধে শহীদ হন। তাঁকে মরণোত্তর “বীর উত্তম” খেতাব দিয়ে ভূষিত করা হয়। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ক্যাপ্টেন মাহবুব শহীদ হবার পর তদস্থলে ফ্লাইট লেফটেন্যাণ্ট লিয়াকত আলী যুদ্ধকালীন সময়েই 'এ' কোম্পানীর কমাণ্ডার নিযুক্ত হন। তিনি সাবেক পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের পাইলট ছিলেন। তবে এ ধরনের পদাতিক যুদ্ধে তার কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিলনা। একটু পরে তিনি শত্রুর বুলেটে মারাত্মকভাবে আহত হন। কিন্তু তবু তিনি আহত অবস্থায়ই বীরত্বের সাথে যুদ্ধ পরিচালনা করেন এবং শত্রুর আক্রমনকে ব্যহত করে দেন। এ যুদ্ধে অসাধারণ কৃতিত্ব প্রদর্শনের জন্য তাঁকে বীর উত্তম এবং লেফটেন্যাণ্ট ওয়াকার হাসানকে বীর প্রতীক উপাধিতে ভুষিত করা হয়। এ যুদ্ধে আমরা ৩১-পাঞ্জাব রেজিমেণ্টের ২৫ জন সৈন্যকে জীবিত অবস্থায় বন্দী করি। যুদ্ধবন্দীদের জবানবন্দীতে জানতে পারি যে, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট যে এত বীরত্বের সাথে এবং সাহসের সাথে যুদ্ধ করতে পারে তা কখনও ভাবতে পারেনি।
এ যুদ্ধে পরাজিত হবার পর তাদের মনোবল ভেঙ্গে পড়ে এবং সিলেটের দিকে পলায়ন করে। এ সময় মিত্রবাহিনীও পাকিস্তানী সৈন্যদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। ৪/৫ গুর্খা রেজিমেণ্টকে ছয়টি আর্টিলারী গানসহ সিলেট শহর থেকে প্রায় দূরে হেলিকপ্টারযোগে নামিয়ে দেওয়া হয়। আমাদের ব্রিগেড কমাণ্ডার মেজর জিয়াউর রহমান স্থির করেন যে সিলেট সহরে অন্যান্য সকল বাহিনীর পুর্বেই আমাদের বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করতে হবে। তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে, পাকবাহিনীর শত্রু ঘাঁটির গুলি ভেদ করে অনুপ্রবেশ করব। মিত্রবাহিনী আমাদেরকে হেলিকপ্টারযোগে খাদ্য, রসদ ও অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতিও দিলেন। আমরা জলাভূমি, খাল, বিল ইত্যাদি অতিক্রম করে অনুপ্রবেশ শুরু করি। এ সময় অত্যন্ত শীত ছিল। আমাদের যোদ্ধাদের নিকট কোন শীতবস্ত্র মোটেই ছিলনা। তবু আমাদের সৈন্যদের মনোবল ছিল অত্যন্ত দৃঢ়। কেননা, আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে আমাদের চূড়ান্ত বিজয় অতি নিকটে। পর পর তিন রাত খাল, বিল এবং জলাভুমির মধ্য দিয়ে চলাচল করে শত্রুঘাঁটি দরবশত ও খাদেমনগর অতিক্রম করে আমরা গভীর চা বাগানের মধ্যে প্রবেশ করি। এ সময় আমাদের সঙ্গে কোন খাদ্যদ্রব্য ছিল না