ফলে আমরা নৌকা বদল করে নাম্ন নামক এক ছেলের অন্য এক নৌকায় উঠি। পরে শুনতে পাই, আমাদেরকে সাহায্য করার জন্য ছেলেটিকে পাকবাহিনী গুলি করে মেরে ফেলে।
এরপর আমি সোজা পশ্চিম দিকে নৌকা চালিয়ে কলমচোরা গ্রামে গিয়ে উপস্থিত হই। ওখানকার চেয়ারম্যন দেওয়ান সাহেব তার বাড়িতে দুপুর বারোটার সময় আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করেন। ক্ষুধায় আমাদের তখন জান বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রমন হয়েছিল। আমাদের পরনে তখন মাত্র একটা জাংগিয়া ছাড়া আর কিছু ছিল না। অবশ্য তিনি আমাদের প্রত্যেককে একখানা করে লুঙ্গি দিয়েছিলেন আর কাউকে বা গেঞ্জি আর কাউকে বা শার্ট। আমাকে আগেই নাম্ন ছেলেটা তার একটা গামছা ও গায়ের শার্ট খুলে গিয়েছিল। আমরা খাওয়ার সময় সংবাদ পাই যে, আমাদের ধরার জন্য পাকসেনা ও বেশকিছু রাজাকার আমাদের দিকে আসছে। এমতবস্থায় আমরা তাড়াতাড়ি অল্প কিছু নাকে মুখে দিয়ে ওখান থেকে সরে পড়ি। সন্ধ্যার সময় ষ্টুয়ার্ড মুজিবর রহমানের বাড়িতে গিয়ে উঠি এবং রাত্রি যাপন করি অন্য এক বাড়িতে। সারারাত কোন রকম অনিদ্রায় কাটিয়ে দিই। সকাল হওয়ার সংগে সংগে আমি ছেলেদের খোজে বের হই। অনেক খোজাখুজির পর দুজনের দেখা পাই এবং তাদেরকে সংগে করে আমি চলে আসি সফরমানী গ্রামে ইব্রাহীম (হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক) সাহেবের বাড়িতে। এসে শুনতে পাই গতকাল্য চাঁদপুর বন্দরে যে অভিযান চালানো হয় তার জন্য মাষ্টার সাহেবকে পাকবাহিনী দায়ী করে এবং পরের দিন তাকে গুলি করে হত্যা করে। বাড়িতে যা কিছু মালামাল ছিল সব কিছু লুট করে নিয়ে যায়। নারী নির্যাতন করতেও ছাড়ে নাই। ঘটনা শুনে মনে ভীষন ব্যাথা পাই এবং প্রতিজ্ঞা করি যে, এর প্রতিশোধ নেবই নেব খোদা যদি বাঁচিয়ে রাখেন। মাস্টার সাহেবের দুই ছেলে সাজু ও নিলুসহ আমি আমাদের শিবির আগরতলায় যাওয়ার জন্য তৈরী হতে থাকি। এমন সময় আরও দুজন বিমান বাহিনীর লোক আমার সংগে যোগ দেয়।
শিবিরে এসে শুনতে পাই আমি পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়েছি এবং আমি তাদের নিকট আতুসমর্পন করেছি। এই খবর পাকিস্তান রেডিও থেকে জোরে ফলাও করে প্রচার হয়েছিল। অবশ্য প্রথম অভিযানের দীর্ঘ ১১ দিন আমার কোনরূপ খোজখবর ছিল না। এতে আমার শিবিরের সকলের মনে দারুন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। আমার আগমনে সবাই একসংগে হর্ষধ্বনি দিয়ে আমাকে ঘাড়ে উঠিয়ে আনন্দে হাততালি দিতে শুরু করলো। দুদিন যেতে না যেতে আমার ডাক পড়ে কলিকাতা ফিরে যাওয়ার জন্য। আমাকে বোমারু বিমান করে কলিকাতা নিয়ে যাওয়া হয়। কলিকাতায় এসে সুনতে পেলাম অন্যান্য নৌঅভিযানের মধ্যে সবচাইতে বেশি জাহাজ চাঁদপুর ডুবেছিল। এবং চাঁদপুরের সংবাদ বি বি সি সংবাদ সংস্থা পর্যন্ত পরিবেশন করেছিল।
দ্বিতীয় আক্রমন: কলিকাতা থেকে আবার পলাশী শিবিরে চলে আসে। ইতিমধ্যে আমার জন্য নতুন করে অভিযান চার্ট তৈরী করে রাখা হয়েছে। আমাকে খুলনার মঙ্গলা পোর্ট অপারেশন করতে হবে। এর আগে যে দলকে আমরা মঙ্গলা পোর্ট অপারেশন করতে দিয়েছিলাম তারা বেশী একটা সুবিধা করে উঠতে পারেনি। প্রথম মঙ্গলা দলের অধিনায়ক ছিলেন আমার বন্ধু আহসানুল্লাহ।
আমি এবার ৩০জন ছেলে সংগে করে মঙ্গলা অপারেশননের জন্য তৈরী হতে লাগলাম। আগষ্ট মাসের শেষদিন আমি ৩০ জন ছেলেসহ কলিকাতার ব্যারাকপুর চলে আসি। ওখানে আমাদের জন্য বিশ্রাম শিবির তৈয়ার করা ছিল। ব্যারাকপুর থেকে আমরা প্রয়োজনীয় গোলাবারুদ সহ ৯নং সেক্টর মেজর জলিল সাহেবের সংগে যোগ দিই। আমাকে সাহায্য করার জন্য মেজর জলিল আমাকে লেঃ শামসুল আরেফিন সাহেবকে সংগে দেন। আরও দেন ২০০ জন স্থল গেরিলা বাহিনী। স্থল গেরিলা বাহিনী আমাদেরকে সাহায্য করবে আর প্রয়োজনবোধে পাকবাহিনীর সংগে যুদ্ধ চালাবে। বাকুন্দিয়া শিবির থেকে আমরা আবার হিঙ্গলগঞ্জ শিবিরে চলে আসি। এখানে দুদিন অপেক্ষা করার পর লেঃ শামসুল আরেফিন সহ আমি দলবল নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করি।