পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৫৪৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
518

সেদিকে দৌড় দিই। কিছুদুর যাওয়ার পর আমার সংগে একজন ছেলের দেখা হয়, ওকে সংগে করে আমি আবার পথ চলতে শুরু করি। এদিকে নদীর উভয় পাশ থেকে ভীষণ গোলাগুলি চলছে। আমরা মাথা নিচু করে নৌকার দিকে আসতে থাকি। প্রকৃতপক্ষে আমি এত দূরে চলে গিয়েছিলাম যে নির্দিষ্ট স্থানে আসতে প্রায় দুঘণ্টা লাগে। আমার জন্য সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। নদীতে ছটার মধ্যে পাচটা জাহাজ ডুবে গেছে আর একটি জাহাজ কাত হয়ে পড়ে আছে।

 আমাকে পাওয়ার সংগে শামসুল আরেফিন ও খিজির সংগে সংগে গোলাগুলি বন্ধ করার জন্য আমাদের বাহিনীকে নির্দেশ দেন। গেরিলা বাহিনী একত্র করার পর লোক গণনাকালে আমার দুইজন নৌকমাণ্ডো কম দেখতে পাই। তাদের জন্য আরও প্রায় আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করা হলো। এদিকে পূর্ব আকাশ একেবারে ফর্সা হয়ে আসছে। আর অপেক্ষা করা সম্ভব নয় দেখে আমি নৌকা ছাড়ার জন্য নির্দেশ দেই। পাকসেনার আওতার বাইরে এসে এক নারিকেল বাগানে এসে কিছু ডাব ও নারিকেল পেড়ে খেয়ে সকালের নাস্তা সেরে দুপুরে শিবিরে ফিরে দেখি আমার ছেড়ে আসা ছেলে দুটি আমার আগেই শিবিরে পৌঁছেছে। ঐদিন বিকাল বেলা পোস্ট মাস্টার সাহেব আমাদেরকে জানান যে, পাকসেনাদের মনোবল খুবই ভেঙ্গে পড়েছে। আরও জানা গেল, গোলাবারুদ ভর্তি দুটি জাহাজ চিটাগাং বন্দরে পাঠানোর জন্য একেবারে নদীর ধারে রাখ হয়েছে। এ ছাড়া আশে পাশে কয়েকখানা খাদ্য জাহাজও আছে।

 আমি বিকালবেলা আমার অন্য সহকর্মী দ্বিতীয় কমাণ্ডার মালেকের সংগে অল্প কয়েকজন বাছা বাছা নৌ কমাণ্ডো ছেলে এবং আরেফিন ও খিজিরের একটি গ্রুপসহ মাত্র বারটা লিমপেট মাইন নিয়ে দুইটি নৌকা করে আবার নদীর ধারে চলে আসি। আগের দিন আমাদের আক্রমণ উল্টা দিক থেকে চালানো হয়েছিল। এবারে বনের পাশ ঘেষে সন্ধ্যার আগেই সি এণ্ড বি রাস্তায় এসে পড়ি। রাস্তা থেকে জাহাজের সমস্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখতে পাই। তাতে মনে হলো,আমাদের কাজ খুব সহজ হবে। তিনটি জাহাজের উপর মাত্র কয়েকজন লোক দেখলাম।

 আমার দ্বিতীয় কমাণ্ডার মালেক জাহাজ তিনটির অপারেশনে নিজে সংগে থাকার অনুমতি চাইল। কাল বিলম্ব না করে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসার সাথে সাথে সে অন্য দুইদলসহ চারটি করে মাইন নিয়ে নদীতে নেমে পড়ে। দূরত্ব বেশী না থাকায় ১৫ মিনিটের মধ্যে জাহাজের গায়ে মাইন লাগিয়ে নিকট ফিরে আসে। তাদেরকে নৌকায় যেতে নির্দেশ দিয়ে আমরা গাছের আড়ালে আত্মগোপন করে মাইন ফাটার অপেক্ষায় থাকলাম। এত তাড়াতাড়ি যে আমরা তিনটি জাহাজে মাইন লাগাতে পারবো তা ধারণা করতে পানিনি। বেশী সময় অপেক্ষা করতে হল না। ১৫মিনিটের মধ্যেই গোলবারুদ ভর্তি জাহাজে প্রথম মাইন বিস্ফোরিত হয়। সংগে সংগে বিকট আওয়াজ করে তিনটি জাহাজ প্রায় আধঘণ্টার মধ্যে ডুবতে আরম্ভ করে। যখন বন্দররক্ষীদের নিকট থেকে গুলি ছোড়া আরম্ভ হয় তখন আমরা আমাদের অবস্থান গোপন রাখার জন্য পাল্টা গুলি ছুড়তে আমার প্রতিরক্ষা বাহিনীকে নিষেধ করি। ওখানে আর কাল বিলম্ব না করে দলবলসহ শিবিরে ফিরে আসি। পরদিন দুপুরে কোন রকমে চারটা পেটে দিয়ে আমরা ওখান থেকে নৌকাযোগে সরে পড়ি এবং গোলাবারুদ সংগ্রহ করার জণ্য পুনরায় বাকুন্দিয়া শিবিরে মেজর জলিল সাহেবের নিকট ফিরে আসি। মেজর জলিল আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন এবং আমাকে অশেষ ধন্যবাদ দেন। তিনি পরদিন আমাকে বারাকপুরে যেতে নির্দেশ দেন।

 মঙ্গলা পোর্টে পর পর দুইটি অপারেশনে নয়টা জাহাজ ডুবেছিল। এ সংবাদ বড় বড় অক্ষরে আনন্দ বাজার পত্রিকায় ফলাও করে প্রচার কর হয়। তাছাড়া পৃথিবীর অন্যন্য সংবাদ সংস্তা যেমন বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা থেকেও নাকি প্রচার করা হয়েছিল। তখন হিন্দুস্থান নেভী নাকি এস ও এর সংকেত ডায়মণ্ড হারবার থেকে শুনতে পেয়েছিল।