পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৫৪৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
524

 গেরিলা বাহিনীতে স্কুল-কলেজের ছাত্র এবং যুবকরা বেশির ভাগ যোগ দিয়েছিল। ট্রেনিং শেষ করার পর প্রত্যেক সেক্টরে কতজন গেরিলা পাঠানো হবে তা হেডকোয়ার্টার থেকে নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল এবং অস্ত্রশস্ত্রের পরিমানও নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল। গেরিলা যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে গেরিলারা সুশৃংখলভাবে কাজ করছিল না। অবশ্য তার কারণও অনেক ছিল, যেমন- তারা অস্ত্রশস্ত্র পেত না, নেতৃত্ব ও সংগঠন ছিল না। পরে আমরা ভারতীয় গোয়েন্দা বিভাগের লোকজনসহ বসে ঠিক করে দিতাম কোথায় গেরিলা অপারেশন চালাতে হবে কখন চালাতে হবে এবং অপারেশনের পর আমাদেরকে তার বিশদ বিবরণ জানাতে হবে। প্রকৃতপক্ষে তখন থেকেই গেরিলা যুদ্ধ কার্যকরী হয়েছিল।

 গেরিলা যুদ্ধের শক্তি বৃদ্ধির সাথে সাথে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গ্রাম এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চলাচল মারাত্নক বিপন্ন হয়ে উঠেছিল। কোথায় যে মুক্তিযোদ্ধারা আছে তাও তারা বলতে পারত না। সব সময় একটা ভয় তাদের মধ্যে ছিল। মুক্তিবাহিণীর এই সাফল্য পাকিস্তান সেনাবহিনীর বাংলাদেশে পরাজয়ের অন্যতম প্রধান কারণ।

 প্রথম দিকে বিমান বাহিনীর সমস্ত পাইলট টেকনিশিয়ান স্থল যুদ্ধে অংশগ্রহন করেছিল। পরে স্থির করা হল একটা এয়ার ফোর্স ইউনিট গঠন করতে হবে। ভারতীয় বিমান বাহিনী আমাদেরকে একটা অটার, একটা অলওয়েট হেলিকপ্টার এবং একটা ডিসি-৩ ডাকোটা বিমান দিয়েছিল।

 পাইলটের মধ্যে ছিল স্কোয়াড্রন সুলতান মাহমুদ, ফ্লাইট লেফটেন্যাণ্ট বদরুল আলম, ফ্লাইট লেফটেন্যাণ্ট শামসুল আলম, ক্যাপ্টেন মরহুম মালেক, ক্যাপ্টেন মরহুম শরফুদ্দিন, ক্যাপ্টেন সাত্তার, ক্যাপ্টেন মুকিত, ক্যাপ্টেন শাহাব, ক্যাপ্টেন আকরাম, এবং এয়ার ফোর্সের প্রায় ৭০ জন টেকনিশিয়ান। যেহেতু আমাদের কমসংখ্যক পাইলট এবং বিমান ছিল সেহেতু আমরা পরিকল্পনা নিলাম যে আমরা এমনভাবে অপারেশন চালাব যাতে করে আমাদের পাইলট বা বিমান না হারায় বা ক্ষয়ক্ষতি হয়। এই সমস্ত বিমান বোমা, রকেট এবং মেশিনগান দিয়ে সজ্জিত করা হয়। ২৮শে সেপ্টেম্বর ন্যাগাল্যাণ্ডের ডিমাপুরে বিমানবন্দরে এদেরকে একত্রিত করা হল। আমরা রাতে আক্রমন চালাব ঠিক করলাম। প্লেনগুলোকে মাটির ওপর ৩০০ ফুটের নিচে দিয়ে ফ্লাই করার সিদ্ধান্ত নেয়া হল। কেননা ৩০০ ফুটের নিচে উড়লে রাডার স্ক্রিনে তা ধরা পরে না।

 কোন নেভিগেশন সাহায্য ছাড়াই আমরা রাতে ট্রেনিং শুরু করি। বনজঙ্গলের মধ্যে গাছের ঠিক উপর দিয়েই আমরা উড়তাম। নিকটবর্তী এক পাহাড়ের চুড়ায় সাদা প্যারাসুট ফেলে সেটাকে টারগেট করে মেশিনগান, রকেট, বোমা ছোড়া হত বা নিক্ষেপ করা হত। আমি নিজে বিমানে উঠে ট্রেনিংয়ে সাহায্য করতাম। সারারাত ধরে ট্রেনিং এর কাজ চলত। অল্পদিন পরেই বুঝতে পারলাম যে নিচু লেভেলে উড়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গিয়ে আমরা কার্যকরভাবে অপারেশন চালাতে পারব।

 ৩রা ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করে। এই যুদ্ধ ঘোষনার আগে ভারতের মাটি থেকে আমরা যদি বিমান হামলা চালাতাম তাতে অনেক অসুবিধা ছিল। তাই ভারতের সাথে এ ব্যাপারে আমাদের একটা বোঝাপড়া হয়েছিল কখন আমরা আক্রমন চালাব। সবশেষে সেই সুযোগ আসল।

 ৩রা ডিসেম্বর রাত দুটোর সময় একই সময়ে আমাদের বিমান চট্টগ্রাম বন্দরের নিকটবর্তী অয়েল ডাম্প এবং নারায়নগঞ্জের কাছে গোদানাইলে বিমান হামলা চালায় এবং এ হামলা খুব কার্যকরী হয়েছিল। এর পর থেকে আমরা বিমানে দিনের বেলাতেও আক্রমন চালাতাম। মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় বাহিনীকে আমরা এয়ার সাপোর্ট দিয়েছি। এমন অনেক জায়গা ছিল যেগুলো ভারতীয় পাইলটরা চিনত না বা জনত না, সেখানে আমাদের পাইলটরা গিয়ে আক্রমন চালিয়েছে। যুদ্ধর অগ্রগতির সাথে সাথে বিশাল এলাকা মুক্ত হতে লাগল। প্রথমত মুক্তি এলাকাগুলোর প্রশানস সেক্টর কমাণ্ডারদের উপর ন্যস্ত করা হয়। আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে যুদ্ধ খুব সুন্দরভাবে চলছে। ১৪ই ডিসেম্বর পর্যন্ত আমরা বুঝলাম যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করবে।