পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৫৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
30

আমাদের বুঝাতো: এই হচ্ছে বল্লবপুর গ্রাম স্যার। আর এখানে আছে বড় একটা পুকুর। মেশিনগানটি বসানো আছে এখানে। এই এলাকায় মাইন লাগানো আছে। কিন্তু স্যার গরু বাছুর এখান দিয়ে হেঁটে যেতে দেখেছি কিছুই হয়নি। তাই ওটা নিশ্চয়ই ভুয়া মাইন ক্ষেত্র। এই যে এখানে একটি স্কুল বিল্ডিং, অফিসাররা এখানে থাকে। এই ভাবে যুদ্ধের এলাকার সব কিছু ছেলেটি আমাদের বুঝিয়ে দিতো।

 বিভিন্ন অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করে জেনারেল অরোরা তাঁর পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছিলেন। প্রধান লক্ষ্যে ছিলো, যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব ঢাকা মুক্ত করা। শত্রুর শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ঘাঁটিগুলো এড়িয়ে এবং যোগাযোগ ও সরবরাহ লাইন দখল করে দ্রুতগতিতে ঢাকা দখল করাই ছিল পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য।

 ঢাকা একবার মুক্ত হয়ে গেলেই শত্রুর বিচ্ছিন্ন অবস্থানগুলো আপনা-আপনি আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে। তাহলে অত্যন্ত ধীরে সুস্থে এই সব এড়িয়ে যাওয়া অবস্থানগুলোকে ধ্বংস করা যাবে।

 প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতাসমূহ যুদ্ধের লক্ষ্য নির্ধারণ করে। চূড়ান্ত বিজয় লাভ হলে এটা অপরিহার্য হয়ে পড়ে যে, ঢাকাকে আসল লক্ষ্যবস্তু হিসাবে যুদ্ধ চালাতে হবে এবং অন্যান্য লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করতে হবে প্রাকৃতিক সেক্টর হিসাবে আলাদা ভাবে।

 উত্তর-পশ্চিম সেক্টরের বগুড়া ছিলো প্রধান যোগাযোগ কেন্দ্র। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, এই সেক্টরের সকল জায়গার শত্রু সৈন্যদের উপর আক্রমণ চালিয়ে তাদেরকে শেষ করতে হবে তবে প্রধান অভিযান ঘোড়াঘাট ও গোবিন্দগঞ্জ হয়ে বগুড়া মুক্ত করার লক্ষ্যেই পরিচালিত হবে।

 পশ্চিম সেক্টরে যশোর ছিল প্রধান যোগাযোগ কেন্দ্র। ঝিনাইদহ-মাগুরা-ফরিদপুর হয়ে ঢাকার সাথে এর সংযোগ। তাই ঝিনাইদহ এবং মাগুরা দখল করতে পারলে যশোরে পাকিস্তনীরা বিপাকে পড়বে এবং মিত্র বাহিনীর পক্ষে দ্রুত ঢাকা অভিমুখে যুদ্ধাভিযান চালানো সম্ভব হবে। তাই মূল হামলা ঝিনাইদহ-মাগুরা দখলের উদ্দেশ্য পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে শত্রুকে বিভ্রান্ত করার জন্যে যশোরের দিকে একটা আক্রমণ চালাবারও সিদ্ধন্ত নেয়া হয়।

 উত্তর সেক্টরে মিত্র বাহিনীর একটি ব্রিগেডকে জামালপুর-টাঙ্গাইল সড়ক হয়ে ঢাকা অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়।

 পূর্ব সেক্টরে লক্ষ্য রাখতে হবে, ঢাকা যেন চট্টগ্রাম কিংবা কুমিল্লা থেকে কোন সাহায্য না পেতে পারে। মেঘনা নদী বরাবর তিনটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অর্থাৎ চাঁদপুর, দাউদকান্দি এবং আশুগঞ্জ দখল করতে পারলেই এই উদ্দেশ্য হাসিল করা সম্ভব। প্রথম অবস্থায় কুমিল্লা, গ্যারিসন এড়িয়ে গেলেও চলবে।

 ঢাকা মুক্ত করার লক্ষ্যে দাউদকান্দি থেকে ভৈরব পর্যন্ত মেঘনা নদীর উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা এবং এরপর জামালপুর-টাঙ্গাইল অক্ষ বরাবর অগ্রসররত দলটির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে রাজধানী অভিমুখে যুদ্ধাভিযান পরিকল্পনার অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে পড়ে।

 পশ্চিম সেক্টরের অগ্রসরমান কলামের জন্য গোয়ালনন্দঘাট দিয়ে পদ্মা পার হওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। বিশাল এই নদীটি পার হওয়ার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আগে থাকতেই করে রাখতে হবে।

 চট্টগ্রাম অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার সময় আমর সঙ্গে নিজস্ব এক ব্রিগেড সেক্টর ট্রুপস ছাড়াও ভারতীয় ২টি বাহিনীর ব্যাটালিয়ন এবং বেঙ্গল রেজিমেণ্টর একটি ব্যাটালিয়ন ছিলো। এই সব সেনা নিয়ে গঠিত হয় বিচিত্র এক বাহিনী যার নাম দেয়া হলো 'কিলো ফোর্স'। আমাদের পথ ছিলো সবচাইতে দীর্ঘতম অথচ যানবহনের সংখ্যা ছিলো সবচাইতে কম। ফিল্ড আর্টিলারী আমাদের সহায়তায় ছিলো বটে, তবে কোন ট্যাংক কিংবা অন্য কোনো প্রকার সাহায্যকারী ইউনিট ছিল না। এই সেক্টরে আমি ইতিমধ্যেই শত্রুর পশ্চাৎভাগে দুটি নিয়মিত