বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৫৫৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
529

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দশম খণ্ড

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৬। চূড়ান্ত পর্যায়ে সংঘটিত যুদ্ধের বিবরণ ......[] ১৯৭১

চূড়ান্ত যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী

 ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের শেষের দিকে প্রতিটি সেক্টর এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস, ক্ষিপ্রতা ও অবশ্যম্ভাবী বিজয় দেখে পাকিস্তানী বাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। সীমান্ত অঞ্চলে বিরাট এলাকা মুক্তিবাহিনী দখল করে নেয়। সারাদেশে গেরিলা তৎপরতা এতো বৃদ্ধি পায় যে পাকসেনারা আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং তাদের মনোবল সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ে।

 পরিস্থিতি ক্রমশঃ পাকিস্তানী ও ভারতের মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো। প্রায় এক কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নেয়ার জন্য ভারতের অর্থনীতিতে প্রবল চাপ সৃষ্টি হয়। ভারত বৃহৎ শক্তিবর্গকে একটি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য বারবার অনুরোধ জানানোর জন্য কোনো ফলপ্রসূ সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। বিবিসির সাথে ২ আগস্ট এক সাক্ষাৎকারে ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন, “পূর্ব পাকিস্তানী ও ভারতের সীমান্ত বরাবর সংঘর্ষ অব্যাহত থাকলে তা ভয়াবহ যুদ্ধে পরিণত হতে পারে।” আমেরিকান টেলিভিশন সংস্থার সাথে এক সাক্ষাৎকারে ১১ আগস্ট ইয়াহিয়া খান বলেন, “দুটো দেশই এখন যুদ্ধের খুব কাছাকাছি এসে পড়েছে। আমি হুঁশিয়ার করে দিতে চাই যে, পাকিস্তানকে রক্ষার জন্য আমরা যুদ্ধ করবো।”

 ইয়াহিয়া খান প্যারিস থেকে প্রকাশিত ‘লা ফিগারো’ পত্রিকার সাথে এক সাক্ষাৎকারে ১ সেপ্টেম্বর বলেন, “আমি এই মর্মে সমগ্র বিশ্বকে হুঁশিয়ার করে দিতে চাই যে তারা যদি মনে করে বিনা যুদ্ধে তারা এক বিন্দু জমি দখল করতে পারবে তবে তারা মারাত্মক ভুল করছে। এর অর্থই হবে সর্বাত্মক যুদ্ধ।’ পূর্বাঞ্চলীয় কমাণ্ডার অধিনায়ক লেঃ জেঃ এ, এ, কে, নিয়াজী ৭ই অক্টোবর পাকিস্তান টাইমস-এ প্রকাশিত এক ঘোষণার বলেন, ‘যদি ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ চায়, তাহলে সে যুদ্ধ হবে ভারতের ঘাঁটিতে।’

 পাকিস্তানী সমরনায়কদের এসব বল্গাহীন বক্তব্যে এটা পরিষ্কার হয়ে উঠেছিলো যে ভারত ও পাকিস্তান সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে। এমন একটি সর্বাত্মক পাকিস্তান চীন ও আমেরিকার সরাসরি হস্তক্ষেপ আশা করেছিলো। অবশেষে ইয়াহিয়া ২৫ নভেম্বর আমেরিকান সংবাদ সংস্থা এসোসিয়েটেড প্রেসের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ঘোষণা করলেন ‘আগামী দশদিন পরে আমাকে এই রাওয়ালপিণ্ডিতে বসে থাকতে দেখবেন না। আমি তখন সীমান্তে যুদ্ধ করবো।’ ইয়াহিয়া খান তার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করলেন। পাকিস্তান বিমান বাহিনী ৩ ডিসেম্বর বিকেল পৌনে ছ’টার সময় অমৃতসর, পাঠানকোট, শ্রীনগর, যোধপুর ও আগ্রার বিমানবন্দরগুলোতে অঘোষিত বোমার্ষণ করে সর্বাত্মক যুদ্ধের সূচনা করলো।

 স্মরণাতীতকালের ইতিহাসে এই প্রথম একটি আক্রমণকারী দল অতিসহজেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়তে সক্ষম হয়। এর কারণ, সমগ্র দেশবাসী আক্রমণকারীদলকে শুধু অভ্যর্থনাই জানায়নি অত্যাচারী হানাদার বাহিনীর পরাজয়ের জন্য তারা আক্রমণকারীদলকে সর্বপ্রকার সাহায্য করেছে।

 বাংলাদেশ অসংখ্য নদী-নালার দেশ। আক্রমণকারীকে বিলম্বিত ও প্রতিহত করার জন্য নদী-নালা অত্যন্ত অসুবিধাজনকভাবে ব্যবহার করা যায়। কয়েকটি নদী খুবই বিশাল। পাকা রাস্তা দিয়ে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চল যেতে হলে অসংখ্য নদী অতিক্রম করতে হবে। এই বিশাল নদীগুলো সমগ্র দেশকে কয়েকটি ভৌগোলিক


  1. ‘রোববার'-স্বাধীনতা দিবস সংখ্যা ১৯৮৩-তে প্রকাশিত মেজর (অবঃ) রফিকুল ইসলাম, পিএসসি-রচিত প্রতিবেদন থেকে সংকলিত।