পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৫৬৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
539

সৈন্য, বিমান এবং জাহাজ-বোট পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশে পাক দখলদার বাহিনীতে মোট সৈন্য এবং আধা সৈন্য প্রায় চার ডিভিশন। সামরিক বিশেষজ্ঞদের হিসাব মত ঘাঁটি থেকে কোনও সেনাবাহিনীকে উচ্ছেদ করতে হলে আক্রমণকারীর অন্তত তিনগুণ শক্তি চাই। অর্থাৎ বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের জন্য অন্তত বারো ডিভিশন ভারতীয় সৈন্য প্রয়োজন। অথচ তা পাওয়া যাবে না। কারণ, পশ্চিম খণ্ডেও বহু সৈন্য, বিমান এবং জাহাজ রাখা প্রয়োজন। আর, উত্তরের জন্যও কিছু সৈন্য এবং বিমান মজুত রাখতে হবে। পঞ্চমত, এইসব অসুবিধা সত্ত্বেও খুব দ্রুত ঢাকাসহ বাংলাদেশকে মুক্ত করতে হবে-কিন্তু বাংলাদেশে এমন সতর্কভাবে লড়াই চালাতে হবে যাতে সাধারণ নাগরিকের কোনও ক্ষতি না হয়, দেশের কোনও সম্পদ ধ্বংস না হয় এবং লড়াইটা চলে শুধু পাক বাহিনীর সঙ্গে। অর্থাৎ তাড়াতাড়ি লড়াই শেষ করতে হবে, কিন্তু আর পাঁচটা লড়াইয়ের মত সর্বাত্মক লড়াই করা যাবে না। এই পরিস্থিতিতে ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী বাংলাদেশের চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য একটা বিস্তারিত পরিকল্পনা রচনা করল।

 সেই পরিকল্পনা পাঁচটা লক্ষ্য। প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য, ক্ষিপ্রতা। ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী স্থির করল যদি যুদ্ধে নামতেই হয় তাহলে দু' সপ্তাহের মধ্যে ঢাকা পৌঁছতে হবে। কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা। একমাত্রসেই দিকেই এগোতে হবে। অন্যান্য শহর বা ঘাঁটি দখলের জন্য সময় বা শক্তি নষ্ট করা হবে না। সেগুলিকে এড়িয়ে যেতে হবে।

 দ্বিতীয় লক্ষ্য, শত্রুপক্ষকে ধোঁকা দেওয়া। তাকে বোঝাতে হবে যে তার চেয়ে অন্তত চারগুণ শক্তি নিয়ে ভারতীয় বাহিনী আক্রমণ করছে। আর তাকে দেখাতে হবে যে ভারতীয় বাহিনী সবদিক থেকেই আক্রমণ করতে যাচ্ছে যাতে শত্রুপক্ষ তার সৈন্যবাহিনী কোনও একটা এলাকায় জড় না করতে পারে এবং বাংলাদেশের চতুর্দিকে ছড়িয়ে রাখতে বাধ্য হয়।

 তৃতীয় লক্ষ্য, সেই ছড়িয়ে পড়া পাকবহিনীকে আবার একত্রিত হতে না দেওয়া-যাতে পাক বাহিনী রিগ্রুপড হয়ে কোনও দ্বিতীয় পর্যায়ের লড়াইয়ে না নামতে পারে এবং যাতে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সৈন্য সরিয়ে এনে তারা ঢাকা রক্ষার জন্য পদ্মা ও মেঘনার মাঝামাঝি অঞ্চলে কোনও শক্ত ব্যূহ না রচনা করতে পারে।

 চতুর্থ লক্ষ্য, ভারতীয় বাহিনী যাতে পাক বাহিনীর সঙ্গে কোনও কোনও বড় দীর্ঘ যুদ্ধে লিপ্ত না হয়ে পড়ে এবং যেন ভারতীয় বাহিনীর ক্ষতি যথাসম্ভব কম হয়। ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর পরিচালকরা এটাও জানতেন যে কোথাও কোন বড় দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধ হলে তাতে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ক্ষতি হবে এবং জাতীয় সম্পদও ধ্বংস হতে বাধ্য। এই জন্য ভারতীয় বাহিনী প্রথম থেকেই টিক করল বাংলাদেশে ঢুকতে হলে বড় সড়কগুলি এড়িয়ে যাবে। এবং এগোবে কাঁচা পথ দিয়ে-যেখানে পাকবাহিনী তাকে আশা করবে না, যেখানে পাক-বাহিনীর প্রতিরক্ষা ব্যূহ বা মাইন থাকবে না, যেখানে শত্রুপক্ষ ভারী অস্ত্রশস্ত্র আনতে পারবে না এবং যেখানে জনবসতি খুবই কম থাকবে।

 পঞ্চম লক্ষ্য, গোড়া থেকেই এমনভাবে আক্রমণটা চালানো এবং পরিচালনা করা যাতে বাংলাদেশের দখলদার পাকবাহিনীর মনোবল লড়াইয়ের প্রায় শুরুতেই ভেঙ্গে দেওয়া যায় এবং যাতে তারা শেষ পর্যন্ত লড়াই না করে আগেই আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।

 এই পাঁচটা লক্ষ্য সামনে রেখে ভারত বাংলাদেশের প্রায় চতুর্দিকে এইভাবে তার সেনাবাহিনীকে সাজালোঃ

 ২ নং কোর। সদর দফতর-কৃষ্ণনগর। প্রধান- লেঃ জেঃ টি, এন, রায়না। দুটো পার্বত্য ডিভিশন ৯ম ও ৪র্থ। তৎসহ টি-৫৫ এস রুশ ট্যাঙ্কে সজ্জিত একটি মাঝারি আর্মার্ড রেজিমেণ্ট, পিটি-৭৬ সাঁতারু রুশ ট্যাঙ্ক সজ্জিত আর এক হাল্কা ট্যাঙ্ক রেজিমেণ্ট, একটা মাঝারি আর্টিলারি রেজিমেণ্ট-১৩০ মিলিমিটার দূরপাল্লার রূশ কামানসহ ব্রিজ তৈরী করতে পারে এমন একটি ইনজিনিয়ারিং ইউনিট। ৯ম ডিভিশন তার প্রধান ঘাঁটি করল ২৪ পরগনার বয়রার কাছাকাছি। ৪র্থ ডিভিশনের মূল ঘাঁটি হল কৃষ্ণনগর গেদের মাঝামাঝি।