প্রয়োজন হলে সর্বত্র এগিয়ে গিয়ে ওদের ঘাঁটিগুলো ধ্বংস করে দিয়ে আসবে। যেন ওই সব ঘাঁটি থেকে আক্রমণ চালিয়ে ওরা না এপারের মানুষ মারতে পারে। ভারতীয় বাহিনী তাই কপোতাক্ষ অতিক্রম করে এগিয়ে গেল।
সেদিন ২১ নভেম্বর। ওদিক থেকে এগিয়ে এল পাকবাহিনীও। সঙ্গে নিয়ে এল ১৪টা চীনা স্যাফি ট্যাঙ্ক। ভারী ভারী কামান। এবং প্রায় পাঁচ হাজার সৈন্য।
শুরু হল তুমুল লড়াই। ভারতীয় বাহিনীও বাধ্য হয়ে ট্যাঙ্ক নিয়ে এসেছিল। ট্যাঙ্কে, কামানে, মেশিনগানে প্রচণ্ড যুদ্ধ হওয়ার পর দেখা গেল প্রথম রাত্রির লড়াইয়ের শেষে পাকিস্তানের ছয় ঘণ্টা স্যাফি ট্যাঙ্কই ঘায়েল। গোটা আটেক পিছু হটে পালিয়েছে। ভারতীয় বাহিনী কিন্তু সেখানেই পাকবাহিনীকে ছাড়ল না। আরও এগিয়ে গেল। জগন্নাথপুর এবং গরীবপুর ছাড়িয়ে। পাক সেনাবাহিনী ওখানেও বেশ শক্ত প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরী করেছিল। দ্বিতীয় দিন আরও বড় লড়াই হল। এবং সেখানে আরও সাতটা পাকিস্তানী স্যাফি ট্যাঙ্ক ঘায়েল হল। দ্বিতীয় দিনের লড়াইয়ে পাকিস্তান তার বিমান বাহিনীকে পুরোপুরিভাবে আসরে নামাল। প্রথম দিনের লড়াইয়েই পাক বিমান বাহিনী যোগ দিয়েছিল। কিন্তু বেশীক্ষণের জন্য নয়। ভারতীয় বিমান বাহিনী আসার আগেই তারা পালিয়ে যায়। দ্বিতীয় দিন পাক বিমান বাহিনীর বিমান আকাশে ওড়া মাত্র ভারতীয় বিমানেও আকাশে উড়ল। শুরু হল বিমানযুদ্ধ। দুপুর বেলা। তিনখানা পাক স্যাবর জেট ধ্বংস হল সেই লড়াইয়ে।
তেরটা ট্যাঙ্ক, তিনখানা বিমান এবং বেশ কিছু সৈন্যসামন্ত হারিয়ে পাক সেনাবাহিনী রণে ভঙ্গ দিল। ভারতীয় সেনাবাহিনী আর এগোলা না। কারণ, তখনও দিল্লী থেকে তেমন নির্দেশ আসেনি। তবে, জগন্নাথপুর আর গরীবপুর ছেড়েও তারা চলে এল না। ওইখানেই ঘাঁটি গেড়ে বসে রইল। এখানেও একই ফল হল। ভারতীয় গ্রামের উপর গোলাবর্ষণ বন্ধ হল। মুক্তিবাহিনী যশোর ক্যাণ্টনমেণ্টের চতুর্দিকে আক্রমণ করার সুযোগ পেল।
এই পর্যায়ে তৃতীয় বড় লড়াই হয় বালুরঘাটে। পূর্বে যেমন আখাউড়া, পশ্চিমে তেমনি হিলি। বালুরঘাট অঞ্চলটা কুঁজের মত এগিয়ে গিয়েছে বাংলাদেশের ভেতরে। এই কুঁজেরই শীর্ষবিন্দু হল হিলি। হিলি শহরটা পশ্চিম বাংলার ভেতরে, কিন্তু হিলি রেল স্টেশন বাংলাদেশের মধ্যে। এই হিলি স্টেশন হয়েই চলে গিয়েছে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রেলপথ- যে রেলপথ বাংলাদেশের উত্তর খণ্ডের সঙ্গে বাদ বাকি অঞ্চলের যোগাযোগ রক্ষা করছে।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাকবাহিনী বুঝল মুক্তিসেনারা এই রেলপথটা বিছিন্ন করে দেওয়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করবে। তাই শুরু থেকেই তারা হিলি স্টেশনে একটা শক্ত ঘাঁটি তৈরী করল। মুক্তিসেনারা কিন্তু তৎসত্ত্বেও শুরু থেকেই হিলির উপর আক্রমণ চালাচ্ছিল। অক্টোবরের শেষাশেষি ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীও বালুরঘাট অঞ্চলে একটা বড় ঘাঁটি তৈরী করল। পাকিস্তানীরাও ততদিনে হিলির ঘাঁটি আরও শক্ত করেছে। খুব বড় বড় এবং বেজায় মজবুত অসংখ্য বাঙ্কার তৈরী করেছে হিলির চতুর্দিকে। এমনকি রেল ওয়াগন দিয়েও ওরা কয়েকটা শক্ত বাঙ্কার তৈরী করেছিল।
সমগ্র সীমান্তে যখন উত্তেজনা এবং গোলাগুলি চলছে সেই সময় পাকিস্তানী সৈন্যরা ঐ কুঁজের উত্তর ও দক্ষিণ দিক থেকে বালুরঘাটের উপর প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ শুরু করল। প্রথম প্রথম কয়েকদিন ব্যাপারটা শুধু গোলাবর্ষণে সীমাবদ্ধ রইল। তারপর তারা এগোবার চেষ্টা করল তাদের আসল উদ্দেশ্য নিয়ে। সেই উদ্দেশ্য দক্ষিণ দিক থেকে প্রচণ্ড আক্রমণ করে ঐ কুঁজটা কেটে দেওয়া এবং ওইভাবে বালুরঘাটে ভারতীয় সামরিক ঘাঁটিটাকে মূল ভূখণ্ড থেকে বিছিন্ন করে ফেলা। এজন্য তারা বাংলাদেশের ধামরাহাট এবং সাপাথের মাঝামাঝি অঞ্চল থেকে ট্যাঙ্ক এবং ভারী কামান নিয়ে ভারতীয় এলাকায় ঢুকে পড়ারও চেষ্টা করল। ওদিকে ভারতীয় বাহিনীও তখন চুপচাপ বসে নেই। কুঁজের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর প্রস্তুতি দেখেই তারা শত্রুপক্ষের উদ্দেশ্যটা বুঝে গিয়েছিল এবং সেইমত প্রস্তুত হচ্ছিল।