পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৫৭৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
549

সবক'টা কলাম মূল পাক ঘাঁটি এবং সুরক্ষিত পথগুলি এড়িয়ে এগিয়ে আসছে। পাক সমরনায়কদের তখন বুঝতে অসুবিধা হল না যে, মিত্রবাহিনীর মূল উদ্দেশ্য বিভিন্ন পাক ঘাঁটির যোগাযোগ কেটে দেওয়া। এবং পেছন থেকে পাক ঘাঁটিগুলির উপর অতর্কিত আক্রমণ করা। নিয়াজি এবং ঢাকার পাক সমরনায়করা ততক্ষণে আরও বুঝে গিয়েছে যে, মিত্রবাহিনী শধু বাংলাদেশের অঞ্চল বিশেষ দখল করতে চায় না- তারা চায় গোটা বাংলাদেশের পাক বাহিনীকে পরাজিত করতে। তারা বুঝল মিত্রবাহিনী ঢাকার দিকে এগোবেই। কিন্তু তখন তারা এটা ঠিক বুঝতে পারেনি যে, মিত্রবাহিনীর কোন কোন কলাম ঢাকার দিকে এগিয়ে আসবে। নিয়াজি তাই অন্যান্য পাক সমরনায়কদের সঙ্গে পরামর্শ করে সেইদিনই সর্বএ হুকুম পাঠিয়ে দিল-পুল ব্যাক। পুল ব্যাক করে তাদের ঢাকার কাছাকাছি অর্থাৎ পদ্মা- মেঘনার মাঝামাঝি অঞ্চলে ফিরে আসতে বলা হল।

 ৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যে বেলায়ই সেই হুকুম সবগুলি পাক সামরিক ঘাঁটিতে চলে গেল।

 ৬ ডিসেম্বর: ৬ ডিসেম্বর সূর্য ওঠার আগেই কতকগুলি সীমান্ত ঘাটি থেকে পাকবাহিনীর পিছু হটা শুরু হল। কোনও কোনও ঘাঁটির পাক অধিনায়করা আবার অ্যাডভান্স পার্টি পাঠিয়ে পেছেনের খবর সংগ্রহের চেষ্টা করল। এবং অনেকেই দেখল পেছনের অবস্থাও ভাল নয়। একে তো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, তার উপর আবার বহু এলাকায় পেছনে গিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী ঘাঁটি করে বসে গিয়েছে। নিয়াজির ‘পুল ব্যাক নিদের্শের পর তাই গোটা বাংলাদেশের পাকবাহিনীতে ইকটা সত্যিকারের অবাজক অবস্থা সৃষ্টি হল।

 অধিকাংশ পাক সীমান্ত ঘাঁটির সামনেই থখন এক সমস্যা- সীমান্তে ঘাঁটিতে বসে থাকার চেষ্টা করলেও মৃত্যু অনিবার্য, আবার পিছাতে গেলেও বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী। কয়েকটা সীমান্তে ঘাঁটি থেকে তাই নিয়োজিকে জানান হল, পুল ব্যাক করার চেয়ে শক্ত বাঙ্কারে ঘেরা বসে লড়াই চালিয়ে যাওয়াই শ্রেয়।

 কুরমিটোলার নির্দেশ তাই সর্বত্র সমানভাবে পালিত হল না। কোথাও পূর্ণ পুল ব্যাক হল। কোথাও হল আধা - পুল ব্যাক। কোথাও আবার যেমন ছিল তেমনই রইলা। যেসব ঘাঁটিতে ওরা থেকে গেল সেগুলির মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য ময়নামতি, চট্টগ্রাম, জামালপুর এবং হিলি। যেসব ঘাঁটি থেকে পালাল সেগুলির মধ্যে সবচেয়ে আগে নাম করতে হয় শ্রীহট্র এবং যশোরের।

 শ্রীহট্র এবং যশোরের চতুর্দিকে পাকবাহিনী যতগুলি ঘাঁটি করেছিল সবগুলিই ছেড়ে পালাল। পাক নবম ডিভিশনের ইপর পদ্মার দক্ষিণের গোটা অঞ্চলটা রক্ষার দায়িত্ব ছিল। আগেই বলা হয়েছে যে, আনুষ্ঠানিকভাবে লড়াই শুরু হওয়ার আগেই পাক নবম ডিভিশনের সদর দফতর যশোর ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে সরিয়ে মাগুরার নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সদর দফতর সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরও কিন্তু নবম ডিভিশনের সৈন্যসামন্ত ঠিকই সীমান্তে ছিল। চৌগাছায় পরাজয়ের পর তারা তিনভাগে ছড়িয়ে ছিল। ঝিনাইদাহ-মেহেরপুর অঞ্চলে একটা অংশ, ঝিকরগাছার উত্তর-পশ্চিমে আর একটা অংশ এবং সাতক্ষিরা থেকে খুলনা পর্যন্ত আর একটা অংশ।

 ৫ ডিসেম্বর মাঝরাতে ভারতীয় চতুর্থ ডিভিশন আঘাত হানল ঝিনাইদাহের উত্তর-পশ্চিমের পাকবাহিনীর উপর। প্রায় একসঙ্গে ভারতীয় নবম ডিবিশন যা দিল ঝকরগাছ থেকে ঝিনাইদহের পশ্চিমে ছড়ানো অংশটার উপর। এই দুই প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েই পাকবাহিনী একেবারে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। এবং দুদিক থেকে মিত্রবাহিনীর দুটো কলাম যশোর-ঢাকা হাইওয়ের ওপর এস দাঁড়াল। ততক্ষণে নিয়াজির পুল ব্যাক অর্ডার ও এসে গিয়েছে। ৬ ডিসেম্বর ভোর থেকেই তাই গোটা পাক নবম ডিবিশনের পলায়ন পর্ব শুরু হয়ে গেল। ইচ্ছা ছিল গোটা বাহিনীটাই ঢাকার দিকে পালাবে। কিন্তু তা পারল না।কারণ ততক্ষণে ভারতীয় চতুর্থ এবং নবম ডিবিশন যশোর-ঢাকা হাইওয়ের দুটো অঞ্চলে ঘাঁটি করে বসেছে। বাধ্য হয়ে তাই পাক নবম ডিবিশনের একটা অংশ পালাল মাগুরা হয়ে মধুমতী ডিঙ্গিয়ে ঢাকার পথে। আর একটা অংশে পালাল খুলনার দিকে। কুষ্টিয়ার দিক দিয়ে ও পালাল একটা ছোট্ট অংশ। সাতক্ষিরা অঞ্চলে যে পাকবাহিনীটা ছিল এতদিন তাদের সঙ্গে লড়াই চালাচ্ছিল প্রধানত মুক্তিবাহিনীর সৈন্যরা এবং বি-এস-এফের সেপাইরা। পুল ব্যাক অর্ডারের সঙ্গে সঙ্গে তারাও