পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৫৮০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
555

পাক সমরনায়করা সেই খবর পেয়ে বিষম ভয় পেয়ে গেল। তারা ভাবল হয়ত ঢাকার চতুর্দিকেই মিত্রবাহিনী প্রচুর ছত্রীসেনা নামিয়েছে। এবং হয়ত সব খবর তারা তখনও পায়নি। ঢাকার সবাই বুঝল, এবার আর রক্ষা নেই জেনারেল মানেকশর আবেদনও তখন বার বার প্রচারিত হচ্ছে: বাচাঁতে চান তো আত্মসমর্পণ করুন। পালাবার কোন পথ নেই। লড়াই করা বৃথা। আত্মসমর্পণ করলে সব পাকসেনা জেনেভা কনভেনশন অনুসারে ব্যবহার পাবেন।

 ১৩ ডিসেম্বর: মিত্র সেনাবাহিনী যতই ঢাকার দিকে এগিয়ে আসছিল এবং ঢাকার উপর বিমান হানা যতই বাড়ছিল ঢাকার পাক সামরিক নেতাদের অবস্থাও ততই কাহিল হয়ে উঠেছিল। সাধারণত বিপদে পড়লে জেনারেলরা যা করে প্রথম প্রথম এরাও তাই করল- ইসলামবাদের কাছে বার বার আরও সাহয্য পাঠাবার আবেদন জানাল। বলল: ভারত অন্তত ন’ডিভিশন সৈন্য এবং দশ স্কোয়াড্রন বিমান নিয়ে আক্রমণ শুরু করেছে। সুতরাং আমাদেরও অভিলম্বে আরও কয়েক ডিভিশন সৈন্য এবং কয়েক স্কোয়ড্রন বিমান চাই। ইসলামাবাদ প্রথমে ঢাকার কর্তাদের বলেছিল: তোমরা মাত্র কয়েকটা দিন লড়াইটা চালিয়ে যাও। আমরা দিন সাতেকের মধ্যেই পশ্চিমখণ্ডে ভারতীয় বাহিনীকে এমন মার দেব যে তারা নতজানু হয়ে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হবে। এবং তখন যুদ্ধেই থেমে যাবে। সুতরাং তোমাদেরও আর কোনও অসুবিধা থাকবে না কিন্তু দিন পাঁচ ছয়ের মধ্যেই ঢাকার পাক কর্তারা বুঝতে পারল, ওদিকেও বেশি সুবিধা হচ্ছে না। ভারতীয় নতজানু হওয়ারও কোনওই সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না বরং ভারতীয় বাহিনী প্রচণ্ড বেগে ঢাকার দিকে এগোচ্ছে। তখন তারা অনেকেই ভয় পেয়ে গেল। ভয় পেল প্রধানত দুটো কারণে। প্রথমে কারণ, পালাবার পথ নেই। কোথাও যে পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করবে তার উপায় নেই। বিমানবন্দরে পালাবার মত কোনও পথ নেই। মাথার উপরে ভারতীয় বিমান। সমুদ্রে ভারতীয় নৌবাহিনীর অবরোধ। স্থলপথে যেদিকেই যাওয়া যাবে, ভারতীয় সেনা। মুক্তিবাহিনী বা স্থানীয় মানুষের হাতে পড়লে মৃত্যু অনিবার্য। তাদের অত্যাচারের ফলে বাংলাদেশের মানুষ কতটা ক্ষেপে আছে সেটা তাদের জানতে তখন বাকি নেই। তাই মিত্রবাহিনী পদ্মা এবং মেঘনার কলে এসে দাঁড়ানো মাত্রই ঢাকার পাক কর্তাদের মনোবল ভেঙ্গে পড়েছিল। তারা অসহায় বোধ করতে শুরু করেছিল। এর উপর যখন তারা দেখল যে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়ানো পাকবাহিনীও আর ঢাকার দিকে ফিরতে পারছে না তখন তারা অনেকে একেবারে হাত-পা ছেড়ে দিল।

 ওদিকে তখন পূর্ব ও উত্তর দিক থেকে মিত্রবাহিনী ঢাকায় প্রায় পনেরো মাইলের মধ্যে পৌছে গিয়েছে ৫৭ নং ডিভিশনের দুটো ব্রিগেড এগিয়েছে পূর্ব দিক থেকে। উত্তর দিক থেকে এসেছে গন্ধৰ্ব নাগরার ব্রিগেড এবং টাঙ্গাইলে নামা ছত্রী সেনারা। পশ্চিমে সেদিন ৪নং ডিভিশণও মধুমতী পার হয়ে পৌঁছে গিয়েছে পদ্মার তীরে। উত্তর এবং পূর্ব দিক থেকে মিত্রবাহিনীর কামানের গোলা ও পড়া শুরু হয়েছে কুর্মিটোলা ক্যাণ্টনমেণ্টে। এবং বিমান বাহীনীর জঙ্গী বিমানগুলিও বার বার হানা দিচ্ছে ঢাকার সব ক’টা সামরিক ঘাঁটির উপর। পাকবাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য মিত্রপক্ষ সেদিন সর্বতোভাবে সচেষ্টা। একদিকে চলছে কামানে-বিমানে তীব্র আক্রমণ, আর একদিকে বেতার প্রচারিত হচ্ছে আত্মসমর্পণের আবেদন। জেনারেল মানেকশ: বাণী সেদিন প্রচারিত হল রাও ফরমান আলীর উদ্দেশে। জেনারেল মানেকশ বললেন: আমার সৈন্যরা এখন ঢাকাকে ঘিরে ধরেছে এবং তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হবে এবং তাদের প্রতি ন্যায়সঙ্গত ব্যবহার করা হবে।

 বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় সেদিন শত শত পাকসেনা আত্মসমর্পণ করল। এক ময়নামতিতেই আত্মসমর্পণ করল ১১৩৪ জন। কিন্তু তখনও নিয়াজি অবিচল। তখনও সেলড়াই চালিয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এবং তখনও তার সঙ্গে একমত হয়ে প্রচণ্ড লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে খুলনা, বগুড়া এবং চট্টগ্রামের পাক অধিনায়করা।