১৪ ডিসেম্বর: নিয়াজি তখনও গোঁ ধারে বসে আছে, কিন্তু আর প্রায় সকলেরই হৃদকম্প উঠে গিয়েছে। ১৩ তারিখ রাত থেকে ১৪ তারিখ ভোর পর্যন্ত পূর্ব এবং পশ্চিম দিক থেকে মিত্রবাহিনীর কামান অবিরাম গোলা মেরে চলল। গোলাগুলি পড়ল গিয়ে প্রধানত ঢাকা ক্যাণ্টনমেণ্টে। কিন্তু সে গোলার আওয়াজে সারারাত ধরে গোটা ঢাকা কাপল। ঢাকার সবাই সেদিন ভীষন আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। বুঝল, আর রক্ষা নেই। গভর্নর মালিক সেদিন সকালেই সমগ্র পরিস্থিতি বিবেচনার জন্য গভর্নর হাউসে মন্ত্রিসভার এক জরুরী বৈঠক ডাকল। এই বৈঠক বসবার ব্যাপারেও আলী এবং চীফ সেকরেটারি মুজাফফর হোসেনের হাত ছিল। তারা তখনও মনে করেছে, আত্মসমৰ্পন ছাড়া উপায় নেই, রক্ষা নেই।
মন্ত্রীসভার বৈঠক বসল এগারোটা নাগাদ। এবং একটা পাকিস্তানী ওয়ারলেস মেসেজ ধরে মিত্রবাহিনীও প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জেনে গেল সেই বৈঠকের খবরটা। সঙ্গে সঙ্গে সংবাদ চলে গেল ভারতীয় বিমান বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় হেডকোয়ার্টারে। এবং কয়েক মিনেঠের মধ্যেই এক ঝাঁক ভারতীয় জঙ্গী বিমান উড়ে এল ঢাকা গভর্নর হাউসের উপর। একেবারে নিদিষ্ট লক্ষ্যে তারা ছুড়ল রকেট। গোটা পাঁচেক গিয়ে পড়ল একেবারে গভর্নর হাউসের ছাদের উপর। মিটিং তখনও চলছিল। মালিক এবং তার মন্ত্রীরা ভয়ে প্রায় কেদে উঠল। চীফ সেকরেটারি,আইজি পুলিশ প্রভৃতি বড় বড় অফিসাররাও মিটিং- এ উপস্থিত ছিল। তারাও ভয়ে যে পারল পালাল। বিমান হানা শেষ হওয়ার পর মালিক সাহেব তার পাত্র মিত্রদের সঙ্গে আবার বসলেন। এবং তারপর আর পাঁচ মিনিটও লাগল না তাদের সিদ্ধান্তে পৌছতে। তারা সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত করলেন: আমরা সবাই পদত্যাগ করলাম। সেই পদত্যাগের সিদ্ধান্ত তারা সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি প্রতিনিধি রেনড সাহেকে জানাল এবং তাঁর কাছে আশ্রয় চাইল। রেনড সাহেব তখন ইণ্টারকনটিনেণ্টাল হোটেলকে রেডক্রসের অধীনে “নিরপেক্ষ এলাকা” করে নিয়েছেন। এই “নিরপেক্ষ এলাকা” তখন ঢাকার একটি অদ্ভুত জিনিস। গোটা ঢাকা তখনও পাকিস্তানীদের দখলে, শুধু এই হোটেলটা ছাড়া হোটেলটার উপর রেডক্রসের বিরাট বিরাট পতাকা উড়ছিল। বহু বিদেশী এবং পশ্চিম পাকিস্তানী আশ্রয় নিয়েছিল ওই হোটেল। ১৪ তারিখ সেখানে সদলবলে গিয়ে আশ্রয় নিল মালিক সাহেব। তখন ঢাকায় সবাই মনে করছে ওটাই একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়- ভারতীয় বৈমানিকরা কিছুতেই রেডক্রসের বড় বড় পতাকা ওড়া বাড়িতে আক্রমণ করবে না। রেনড সাহেব তার এলাকায় ওদের আশ্রয় দিয়ে খবর পাঠালেন জেনিভায়। সেই বার্তায়: পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সর্বোচ্চ অফিসাররা পদত্যাগ করেছেন এবং রেডক্রস আন্তর্জাতিক অঞ্চলে আশ্রয় চেয়েছেন। জেনিভা চুক্তি অনুযায়ী তাদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশ সরকারকে যেন অবিলম্বে সমস্ত ঘটনা জানানো হয়। খবরটা যেন ভারতীয় সামরিক বাহিনীকে জানানো হয়।
মালিক এবং তার গোটা “পূর্ব পাকিস্তান সরকারের” এই সিদ্ধান্তের অবস্থা আরও কাহিল হল। ঢাকার উপর তখন প্রচণ্ড আক্রমণ চলছে। আক্রমণ চলছে কামানের। আক্রমণ চলছে বিমানের। প্রধান লক্ষ্য কুরমিটোলা ক্যাণ্টনমেণ্ট। নাগরার বাহিনী তখন টঙ্গির কাছে পৌছে গিয়েছে। এবং পাক শীতলক্ষা নদীর একটা শাখার উপরের ব্রিজটা উড়িয়ে দিয়ে ওপর থেকে তাদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে। মূল পাকবাহিনীটা কিন্তু কামান এবং বিমান আক্রমণে প্রায় পাগল হয়ে গিয়ে কুরমিটোলা ছেড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ে আশ্রয় নিয়েছে। পূর্ব দিকের বাহিনীটা ও প্রায় পৌঁছে গিয়েছে ডেমরায়। তবু নিয়াজি তখনও বলছে: আমি শেষ পর্যন্ত লড়ে যাব। নিয়াজি অবশ্য এ কথাটা বলছিল প্রধাণত মারকিনীদের ভরসায়। মারকিনী সপ্তম নৌবহর যে বঙ্গোপসাগরের দিকে এগোচ্ছে এ খবর চার- পাঁচ দিন আগে থেকেই জানা গিয়েছিল। গোটা দুনিয়ায় তখন সপ্তম নৌবহরের বঙ্গোপসাগরে আগমনে নিয়ে জোর জলপনা-কল্পনা চলছে। মারকিন সরকার যদিও ঘোষণা করলেন যে কিছু আমেরিকান নাগরিককে অবরুদ্ধ বাংলাদেশ থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়ার জন্যই সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে যাচ্ছে। আসলে কিন্তু কেউ তা বিশ্বাস করল না। সকলেরই মনে তখন বেজায় সন্দেহ। ঠিক কি মনে প্রশ্ন, প্রেসিডেণ্ট নিকসন কি ইয়াহিয়ার রক্ষার্থে নৌবহরকে আসরে নামাবেন? ঠিক কি উদ্দেশ্যে মারকিন সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে এসেছিল এবং কেনই বা তারা কিছু না করে (বা করতে না পেরে)