পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৫৮৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
558

ভারতীয় বিমান বাহিনী ওই পর্যন্ত কোনও আক্রমণ করবে না। কিন্তু মিত্রপক্ষের স্থল ও নৌবাহিনী যথারীতি অগ্রসর হতে থাকবে। যদি সকাল ৯ টার মধ্যে আত্মসমর্পণের খবর না পাই তাহলে তখন থেকে আবার বিমান বাহিনীর আক্রমণ পুরোদমে শুরু হবে। ঢাকার ভেতর পাকবাহিনীর অবস্থা তখন অত্যন্ত শোচনীয়। তাদের মনোবল একেবারে ভেঙ্গে গিয়েছে।

 জেনারেল মানেকশ তাঁর শেষ বার্তায় পিনডিকে বলেছিলেন: সকাল ন'টার মধ্যে বেতার জানতে হবে বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করছেন কিনা। একটা বেতার ফ্রিকোয়েনসিও বলে দিয়েছিলেন।

 শোনা যায়, নিয়াজি সেদিন সারারাত ধরে ইসলামাবাদের সঙ্গে যোগাযোগর চেষ্টা করে। এ ব্যাপারে বিভিন্ন বিদেশী দূতাবাসেরও সাহায্য নেয়। কিন্তু কোনও ফলই হল না।

 ইয়াহিয়া খাঁকে কিছুতেই পাওয়া গেল না। ওদিকে তখন মিত্রবাহিনীর কামানের গোলার আওয়াজ। বাড়ছে এবং পাকবাহিনীতে গ্রাসও বাড়ছে। ঢাকার অসামরিক পাকিস্তানীরাও আত্মসমর্পণের পক্ষে চাপ বাড়াচ্ছে। চাপ দিচ্ছে কয়েকটা বিদেশী দূতাবাসও।

 ১৬ ডিসেম্বর: সকালে নিয়োজি আবার কয়েকজন বিদেশী দূতের সঙ্গে কথা বলল এবং শেষ পর্যন্ত স্থির করল যে মানেকশর প্রস্তবই মেনে নেবে। তখন শুরু হল ওই ফ্রিকোয়েনসিতে গেয়ে ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা। কয়েকজন বেদেশীর বসে নিয়াজি বারবার সেই চেষ্টা করতে থাকল। সকাল প্রায় সোয়া আটটা থেকে। কিন্তু কিছুতেই যোগাযোগ করতে পারল না। ন'টা যখন বাজে বাজে তখন গোটা ঢাকা আকাশবাণীর কলকাতা স্টেশন খুলে কান পেতে বসে রয়েছে। তারাও ভীষণ ভীত। তাঁরাও বুঝতে পারছিলেন, ঢাকার লড়াই যদি হয়ই তাহলে তাদেরও অনেকের প্রাণ যাবে। তারাও তখন জানতে একান্ত আগ্রহী নিয়াজি মানেকশর প্রস্তাবে রাজী হয় কিনা। কিন্তু হায়, ন'টার সংবাদে তারা আকাশবাণীর বাংলা খবরে জানতে পারলেন, নিয়াজি কোনও জবাবই দেয়নি! বিসান আক্রমণ বিরতির সময়ও শেষ হয়ে গিয়েছে! ঠিক তখনই নিয়াজি মিত্রবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছে। জানিয়েও দিয়েছে যে তারা বাহিনী বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করবে। তখনই ঠিক হল, বেলা বারোটা নাগাদ মিত্রবাহিনীর চীফ অব স্টাফ জেনারেল জ্যাকব ঢাকা যাবেন নিয়াজির সঙ্গে আত্মসমর্পণের ব্যাপারটা পাকা করতে। ওদিকে তখন জেনারেল নাগরার বাহিনীও প্রায় মীরপুরের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। ঢাকা-টাঙ্গাইল রোড়ের ওপর নাগরায় বাহিনীর আটকে পড়েছিল। টঙ্গির কাছাকাছি। নদীর ওপরের ব্রিজটা পাকিস্তানীরা ভেঙ্গে দিয়েছিল।

 ১৬ তারিখ ভোর নাগরার বাহিনী নয়ারহাট ফরেস্ট রোড় দিয়ে সাভারের কাছাকছি এসে ঢাকা- আরিচাঘাট রোড়ের উপর পড়ল। পাকবাহিনী এই রাস্তায় ভারতীয় বাহিনীকে আশাই করেনি। তাই ওদিকে কোনও প্রতিরোধের ব্যবস্তাই রাখেনি। এমনকি ব্রীজগুলি পর্যন্ত ভাঙ্গেনি। আরিচাঘাট রোড়ে পড়ে গন্ধর্ব নাগরার বাহিনী সোজা ঢাকার দিকে এগালো। মাত্র কয়েক মাইল। প্রথমেই মীরপুর। পাকবাহিনীর জেনারেল জামসেদ সেখানে গিয়ে নাগরার কাছে আত্মসমর্পণ করল। নাগরার বাহিনী ঢাকা কয়েক মিনিটের মধ্যেই জেনারেল জ্যাকব হেলিকাপ্টারে ঢাকা পৌঁছলেন। নিয়াজির সঙ্গে কথাবার্তা পাকা হল। আত্মসমর্পণের দলিলও তৈরী হল। বিকাল ৪টা নাগাদ সদলবলে ঢাকা পৌঁছলেন মিত্রবাহিনীর প্রধান জেনারেল অরোরা। ৪-২১ মিনিটে ঢাকার রেস কোর্সে জনতার “জয় বাংলা” ধ্বনির মধ্যে নিয়াজি আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করল। বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে থাকা পাকবাহিনী কাছে ততক্ষণে আত্মসমর্পণের নির্দেশ চলে গিয়েছে। সেদিন লড়াই চলছিল শুধু চট্টগ্রাম এবং খুলনায়। পাক নবম ডিভিশনের প্রধান ওইদিন সকালে নিজে থেকেই আত্মসমর্পণ করেছিল। মধুমতী নদীর পূর্ব তীরে। চট্টগ্রাম শহরেও ভারতীয় সৈন্য তখন প্রায় ঢুকে পড়েছে। আর খুলনার পাকবাহিনীর একটা অংশ তখন খালিশপুরের অবাঙ্গালী জনবসতির মধ্যে ঢুকে পড়ে মিত্রবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ চালাচ্ছে।

 নিয়াজির আত্মসমর্পণের পর সব যুদ্ধই থেমে গেল। ১৬ ডিসেম্বর থেকেই বাংলাদেশ মুক্ত এবং স্বাধীন।