পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৫৮৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
562

অস্ত্রশক্তি প্রয়োজন সেখানে তারা প্রথম লক্ষ্য দেবেন এবং আমাদের বাহিনী শত্রুকে 'আউটফ্লাঙ্ক' অর্থাৎ শত্রুকে দু'পাশ দিয়ে অতিক্রম করে- ‘ক্রস কাণ্ট্রি' দিয়ে গিয়ে ব্যূহের পার্শ্বভাগে আক্রমণ করবে অথবা ভারতীয়রা সামনের দিকে শত্রুকে ঠেকিয়ে রাখবে এবং আমাদের বাহিনী 'আউটফ্লঙ্ক' করে পেছন দিক দিয়ে আক্রমণ করবে। যেহেতুে অঞ্চলগুলো সম্পর্কে আমাদের বাহিনীর অভিজ্ঞতা ছিলো, আমার বাহিনী হাল্কা ছিলো ও ক্ষিপ্রতার সাথে রণাঙ্গনে চলাচলে সক্ষম এবং যেহেতু অঞ্চলাগুলো সম্পর্কে আমাদের বাহিনী সম্পূর্ণ সজাগ ছিলো। সে জন্যে এই কাজগুলো করার দায়িত্ব ছিলো আমাদের উপর। যেখানে অধিকসংখ্যক গোলাবারুদ, বিমান বা ট্যাঙ্কের আক্রমণ করতে হবে সেখানে ভারতীয় বাহিনী শক্তি নিয়োগ করবে।

 যেসব অঞ্চল কেবলমাত্র বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী অর্থাৎ মুক্তিবাহিনী মুক্ত করেছিলো সেখানে আমাদের বাহিনী সম্পূর্ণভাবে আমাদের নিজেদের পরিকল্পিত পদ্ধতিতেই যুদ্ধ করেন। আমাদের বাহিনী যেসব অঞ্চল এভাবে মুক্ত করে তার মধ্যে উত্তরবঙ্গের কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট অঞ্চল, সিলেটের সুনামগঞ্জ ও দুতিক অঞ্চল, হবিগঞ্জ, কুমিল্লা, আখাউড়া ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উত্তরাঞ্চল, চট্টগ্রামের করেহাট, হায়াকু, হাটহাজারী অঞ্চলের ‘এক্সেস অব এডভান্স, কুষ্টিয়ার আলমডাঙ্গা, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর অঞ্চল, যশোরের মনিররামপুর ও অভয়নগর অঞ্চল, খুলনার বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও কালিগঞ্জ অঞ্চল, ফরিদপুর সদর, মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জ অঞ্চল, বরিশাল ও পটুয়াখালী অঞ্চল এবং ঢাকা পৌঁছার শেষ পর্যায়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ভৈরব, নরসিংদী, ঢাকা-এই ‘এক্সেস অব এডভান্স' রয়েছে। শেষ পর্যন্ত মিত্ররাও এই পদ্ধতিটি বেশী কার্যকর বলে মেনে নিয়েছিলেন। এই পদ্ধতি ছিলো- শত্রুর সেখানে পাকা বাঙ্কার বা রি-ইনফোর্সড কংক্রিটের শক্তিশালী ব্যূহ বা স্ট্রং পয়েণ্ট রয়েছে সেখানে গিয়ে সরাসরি ঢুঁ মারা বুরবকের কাজ। এ ক্ষেত্রে যা করতে হবে তা ১৯৪২ সালে জাপানীরা বৃটিশ বাহিনীকে (যাতে আমিও ছিলাম) শিখিয়েছিলো। এক্ষত্রে সামনে দিয়ে শত্রুকে ব্যস্ত রাখতে হবে এবং তাকে 'আউটফ্লঙ্ক' করে ওর পেছনে গিয়ে স্ট্রং পয়েণ্ট বানিয়ে বসুন। সে যাবে কোথায় এবং ওর রি-ইনফোর্সমেণ্ট ও গেলাবারুদ, রসদ ইত্যাদি আসবে কেথেকে? এইভাবে তাকে বিছিন্ন করে তার ব্যূহের পেছনে ও পার্শ্বভাগে আঘাত করুন। প্রথম প্রথম মিত্রদের অনেকে ভাববেন তাকে বিছিন্ন করে তার ব্যূহকে পেছনে ও পার্শ্বভাগে আঘাত করেন। প্রথম প্রথম মিত্রদের অনেকে ভাবতেন আমরা কি ভীতু নাকি! তারপর একটি অভিজ্ঞাতা হওয়ার পর বুঝলেন যে আমাদের পদ্ধতিই একমাত্র কার্যকর রণপদ্ধতি। এইভাবে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের কেবল একটি ব্যাটালিয়ন শত্রুর ১৪নং ডিভিশনকে আশুগঞ্জের যুদ্ধের পর ঘেরাও কের অকেজো করে দেয়।

 তাই যেসব অঞ্চলে আমরা একা যুদ্ধ করেছি সেখানে আমাদের পদ্ধতি ছিলো, শত্রুর শক্তিশালী ঘাঁটিকে বিছিন্ন করে তাকে সম্মুখভাগে ব্যস্ত রেখে তাকে 'আউটফ্লাঙ্ক' করে পেছনে গিয়ে বসা এবং তারপর পার্শ্বভাগ ও পেছনের দিক থেকে আক্রমণ করে তাকে ধ্বংস করা। অভ্যন্তর ভাগের গেরিলাদের (গণবাহিনীর) ও আমাদের নিয়মিত বাহিনীর আক্রমণের সামঞ্জস্য বিধন করা। নির্দেশ থাকতো, গেরিলারা যখন অমুক জায়গায় আক্রমণ করবে তখন দৃষ্টিকে অন্যদিকে ধাবিত করতে হবে এবং শত্রুর যাতে গোলাগুলি ও রি- ইনফোর্সমেণ্ট না আসতে পারে তার ব্যবস্থা করবে। গেরিলারা অমুক জায়গায় অমুক পুলটি উড়াবেন। তবে আমরা বড় বড় পুলগুলোতে হাত দিইনি। সেই পুলগুলো শত্রুরাই আত্মসমর্পণের আগে ভেঙ্গেছিলো।

 যেখানে সম্মিলিতভাবে কাজ করেছি সেখানে কৌশল ছিলো যেখানে অধিক অস্ত্র, গোলাবারুদ, ট্যাঙ্ক ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দবে, 'এক্সেস অব এডভান্স'-এ ভার শত্রুর স্ট্রং পয়েণ্টের উপর চাপ প্রয়োগ করবে এবং বাংলাদেশ বাহিনী 'আউটফ্লাঙ্ক' করে গিয়ে পার্শ্বভাগে বা পেছনের দিক থেকে আক্রমণ করবে।

 এর সঙ্গে সঙ্গে এটাও সুস্পষ্ট নীতি ছিলো যে, স্ট্রং পয়েণ্টগুরো ‘ক্লিয়ার করার পরবর্তী পর্যায় শত্রুর অন্য পজিশনগুলো আয়ত্ত্ব করতে হবে, সেখানে মুক্তিবাহিনী অর্থাৎ বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী এগোবে। তাঁদের অগ্রাভিযানে ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনী যতোটুকু সাপোর্ট দেয়ার ঠিক ততোটুকু দেবে।

 প্রঃ মক্তিবাননী ও ভারতীয় বাহিনী যখন একসাথে এগোতে তখন অগ্রবর্তী দল হিসেবে মুক্তিবাহিনী যেতো এবং সাপোর্ট আসতো ভারতীয় বাহিনীর কাছ থেকে-তাই কি?