পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৫৯১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
566

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দশম খন্ড

জন্যে থাকতো বিভিন্ন ধরনের বিস্ফোরক। নৌ কমাণ্ডদের আত্মরক্ষার জন্যে হাল্কা অস্ত্র থাকতো, বেশীর ভাগ সময়ই গ্রেনেড। আর থাকতো অপারেশনের প্রয়োজনীয় সামগ্রী, যেমন-লিপ্টেট মাইন।

 যুদ্ধ শেষ হওয়া আমার তাই সৈন্যসংখ্যা ছিল ২০-২৫ হাজার নিয়মিত বাহিনী এবং ৭০/৮০ হাজার গণবাহিনী।

 প্রশ্নঃ গণবাহিনীর কোন আলাদা সেক্টর ছিল কিনা? সি-ইন-সি স্পেশাল সংগঠনটিও বা কি ছিল?

 জেনারেল ওসমানীঃ বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর নাম ছিল মুক্তিবাহিনী। এর ভেতর স্থল, জল, বিমান তিনটিই অন্তর্ভুক্ত ছিল। অনেকে মুক্তিবাহিনী শব্দে ভুল করেন। তারা মনে করেন শুধু গেরিলাদের বুঝি মুক্তিবাহিনী বলা হতো। আসলে তা নয়। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর পুরোটা মিলিয়ে ছিল মুক্তিবাহিনী। এর দুটো অংশ ছিল-(১) নিয়মিত বাহিনী এবং (২) গণবাহিনী ও গেরিলা বাহিনী বা অনিয়মিত বাহিনী। ভারতীয়রা এই শেষোক্ত অংশকে বলতেন এফ-এফ অর্থাৎ ‘ফ্রীডম ফাইটার’। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা তো সবাই। আর গণবাহিনীর ও নিয়মিত বাহিনীর সেক্টর একই ছিল।

 গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আনুগত্য স্বীকারকারী সকলেই এই ১১টি সেক্টরের কোন না কোন একটি সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন।

 সি-ইন-সি স্পেশাল সম্পর্কে এবার বলছি। শুরুতেই গেরিলাদের দু’সপ্তাহ ট্রেনিং দেয়া হতো। কিন্তু এটা যথেষ্ট ছিল না। পরে মেয়াদ খানিকটা বাড়ানো হলো। তখন তিন সপ্তাহের মতো সাধারণ গেরিলা ট্রেনিং দেয়া হতো। এছাড়া আমি কিছুসংখ্যক গেরিলার জন্যে একটি বিশেষ কোর্সের বন্দোবস্ত করেছিলাম। একে বলা হতো স্পেশাল কোর্স। ওটা ছয় সপ্তাহের ছিল। এই কোর্সে গেরিলা লীডারদের প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। এবং আরবান গেরিলা ওয়ারফেয়ার অর্থাৎ শহরাঞ্চলে আবাসিক এলাকায় যুদ্ধ করার পদ্ধতিও তাদের শেখানো হতো। এদের ভূমিকা ছিল গেরিলাদের নায়কত্ব করা এবং সাধারণ গেরিলাদের দিয়ে সম্ভব নয় এমন সব কাজ সম্পন্ন করা। এই প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের সংখ্যা ছিল খুব কম। চাকুলিয়া নামে এক জায়গায় তাদের ট্রেনিং দেয়া হতো। এসব গেরিলারা বিশেষভাবে সিলেট হয়ে যেতো এবং এদের সিলেকশনের ব্যাপারে ব্যক্তিগতভাবে আমি লোক নিয়োগ করেছিলাম। তাই এদের নাম কেই বলতো সি-ইন-সি স্পেশাল। আসলে এ নামে স্বতন্ত্র বাহিনী ছিল না।

 প্রঃ যুদ্ধ পরিচালনার নির্দেশ অর্থাৎ অপারেশনাল ইন্সট্রাকশন বা ডাইরেকটিভস সম্পর্কে কিছু বলুন।

 জেঃ ওসমানী: সরকার গঠনের আগে আমি সর্বপ্রথমে এই যুদ্ধ পরিচালনা করেছি মুখে বলে, যোগাযোগ করে। তারপর আমি কমাণ্ডারদের আমাদের লক্ষ্য বা অবজেকটিভ এবং প্রত্যেক সেক্টরে কি ফলাফল অর্জন করতে হবে তা জানিয়েছি।

 এ জন্যে আমি সাধারণতঃ অপারেশনাল ইন্সট্রাকশন দিতাম। তাতে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের অধিনায়কের উপর দায়িত্ব যথেষ্ট বিকেন্দ্রীকরণ করা হতো। সাধারণ লক্ষ এবং সেই বিশেষ বিশেষ লক্ষ্য ও দায়িত্বের কথা এই হুকুমনামা বা ইন্সট্রাকশনে লেখা থাকতো। এছাড়া আমি একটি জিনিস ব্যবহার করেছিলাম যা নতুন ছিল এবং আমার জানা মতে এর আগে কোন সামরিক বাহিনীতে তা ব্যবহার করা হয়নি। সেটা ছিল অপারেশনাল ডাইরেকটিভস নির্দেশ এবং উপদেশ। পরিস্থিতি যাচাই ও বিবেচনা করে কি পরিমাণ এই ডাইরেকটিভস একজন অধিনায়ক অনুসরণ করবেন তা তার উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। কারণ তা না হলে আমরা যুদ্ধে এগিয়ে যেতে পারতাম না। তবে মৌলিক কয়েকটি বিষয় বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়নি।

 সব সময়ই মন্ত্রীসভাকে- মাসে অন্তত একবার- রণাঙ্গনের মূল্যায়ন অবহিত করতাম।