পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৫৯৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
569

 ডাকোটা বিমানকে পাঁচ হাজার পাউণ্ড বোমা বহন করার উপযোগী করা হলো এবং পরিচালনার জন্য নির্বাচিত করা হলো ক্যাপ্টেন খালেক, ক্যাপ্টেন মুকিত ও আমাকে। অটার বিমানকে সজ্জিত করা হলো সর্বধুনিক রকেট, মেশিনগান ও বোমাবর্ষণের উপযোগী করে।

 পরিচালনার জন্য নির্বাচিত করা হলো ফ্লাঃ লেঃ শামসুল আলম, ক্যাপ্টেন আকরাম ও মরহুম সরফুদ্দিন। হেলিকপ্টারকে সজ্জিত করা হলো রকেট ও ভারী মেশিনগান দ্বারা। পরিচালনার জন্য নির্বাচিত করা হলো স্কোঃ লিঃ সুলতান মাহমুদ, ফ্লাঃ লেঃ বদরুল আলম এবং ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিনকে।

 অতঃপর অক্টোবর মাসের প্রথম তারিখ থেকে এয়ার কমোডর খোন্দকার সাহেবের নেতৃত্বে আমাদের ব্যাপক প্রশিক্ষণ, অনুশীলন ও মহড়া শুরু হলো। নাগাল্যাণ্ড, মনিপুর, অরুনাচল, ত্রিপুরা ও আসামের জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ী এলাকার কোন প্রকার পথ নির্ধারক ব্যতিরেকে শুধু কম্পাসের উপর নির্ভর করে রাত্রির পর রাত্রি আমরা অত্যন্ত নীচু দিয়ে উড্ডয়নের কৌশল আয়ত্ত করার অনুশীলন করতাম। শত্রুর রাডারকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন হয় অত্যন্ত নিচু দিয়ে বিমান চালনা করা এবং সত্যিকারের অভিযানকালে যাতে শত্রুর দৃষ্টিগোচর না হতে হয় সেজন্য প্রয়োজন ছিল রাত্রিতে সঠিক পথে বিমান চালনার অভ্যাস করা। রাত্রিবেলায় নীচু দিয়ে বিমান চালনা এবং প্রদীপবিহীন রানওয়েতে বিমান অবতরণের প্রক্রিয়া আয়ত্ত করার চেষ্টা ছাড়াও বিমান আক্রমণের অন্যান্য পদ্ধতিরও আমরা নিয়মিত অভ্যাস করতাম। এয়ার কমোডর খন্দকার সাহেবের তত্ত্বাবধানে আমাদের অনুশীলন যে কত নিখুঁত ভাবে পরিচালিত হয়েছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় ৩রা ডিসেম্বর থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন রণাঙ্গনে বিমান আক্রমণে আমাদের দারুণ সফলতার মধ্য দিয়ে। পরিকল্পনা মাফিক ঠিকমত আক্রমণ পরিচালনা করতে পারলে ছোট ছোট বিমানও যে অত্যাধুনিক জঙ্গী বিমানের সমকক্ষ হতে পারে তা আমাদের বৈমানিকগণ দুনিয়াবাসীকে দেখিয়ে দিয়েছেন। আমাদের বৈমানিকদের দক্ষতা দেখে ভারতীয় বিমান বাহিনীর উচ্চপদস্থ অফিসাররা বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছেন।

 আমাদের দক্ষতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্তঃ ৩রা ডিসেম্বর মধ্যরাত্রিতে স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ ও ফ্লাঃ লেঃ বদরুল আলম নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে পাকিস্তানী বিমান জ্বালানী ঘাঁটির উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। ফ্লাঃ লেঃ শামসুল আলম ও ক্যাপ্টেন আকরাম আহমদ ঐ একই সময়ে চট্টগ্রামে এক ব্যাপক বিমান আক্রমণ পরিচালনা করেন। চট্টগ্রামের অভিযানের পরে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত ক্যাপ্টেন আকরাম মরহুম সরফুদ্দিনকে নিয়ে ১২ বারেরও বেশী বিভিন্ন রণাঙ্গনে পাক দুশমনদের শক্ত ঘাঁটি ও কনভয়ের উপর আক্রমণ পরিচালনা করে তাদের প্রভূত ক্ষতিসাধন করে। আমার মনে আছে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকলে ডাকোটা, অটার ও হেলিকপ্টার এই তিন গ্রুপের মধ্যে শুধু একটি বিষয়েই প্রতিযোগিতার মনোভাব ছিল, তাহলো কোন গ্রুপ কত বেশী বিপজ্জনক অভিযানের দায়িত্ব লাভ করতে পারে। এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনা উল্লেখ করবো। ডাকোটা বিমান নিয়ে বাংলাদেশের একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বোমাবর্ষণের জন্য একটি দিন স্থির করা হয়। অভিযানটি ছিল ভয়ানক বিপদসংকুল। কিন্তু নির্দিষ্ট দিনের মাত্র একদিন পূর্বে যখন বিশেষ কারণে এই অভিযান পরিকল্পনা বাতিল হয়ে গেল তখন ক্যাপ্টেন খালেক ও ক্যাপ্টেন মুর্কিত অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে যান।

 বিমান আক্রমণ পরিচালনাকালে আমাদের বৈমানিকগণকে অনেকবার মারত্মক বিপদের মুখোমুখি হতে হয়। যেমন ৭ই ডিসেম্বর পরিকল্পনা অনুযায়ী সিলেট শহর শত্রুমুক্ত হয়েছে কিনা জানার জন্য ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিন হেলিকপ্টারযোগে সিলেট বিমান বন্দরে অবতরণ করতে যান। সিলেট শহর তখনও শত্রুমুক্ত হয়নি। তাই অবতরণকালে হেলিকপ্টারটি আক্রান্ত হয়। মেশিনগানের বেশ কয়েক রাউণ্ড গুলি হেলিকপ্টারটিকে বিদ্ধ করে কিন্তু ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিন সফলতার সাথে কৈলাশহর বিমান ঘাঁটিতে ফিরে যান। আবার ১০ই ডিসেম্বর সিলেটের অগ্রবর্তী এলাকা পরিদর্শনকালে ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিনের হেলিকপ্টারের টেইল রোটার ভূমি থেকে নিক্ষিপ্ত গুলির আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে ভারসাম্য যদিও ব্যস্ত হচ্ছিল তবু এবারেও ক্যাপ্টেন শাহবুদ্দিন আশ্চর্য পারদর্শিতার সাথে ঘাঁটিতে ফিরে গিয়ে নিরাপদে অবতরণ করেন।