এই দিনই (১০ই ডিসেম্বর) ঢাকা রেডিওর ট্রান্সমিটারের ওপর সরাসরি এক বিমান হামলায় বেতার প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। ভীক্রান্ত এর বিমান বহর তখন চট্টগ্রাম পোর্ট বিমানবন্দর ও সামরিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য কেন্দ্রের ওপর সমানে আক্রমণ যাচ্ছিলো।
মার্কিন ৭ম নৌ-বহরের টাস্কফোর্স ইতিমধ্যেই মালাক্কা প্রণালী অতিক্রম করে দ্রুত বঙ্গোপসাগরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো। মার্কিনী এই বহরে ছিল পারমাণবিক শক্তি চালিত বিশাল বিমানবাহী জাহাজ ‘এণ্টারপ্রইজ' এবং আরো ৬টি যুদ্ধ জাহাজ। এ ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অজুহাত ছিলো বাংলাদেশে মার্কিন নাগরিকদের সরিয়ে নেয়ার জন্যই ৭ম নৌ-বহরকে এই অঞ্চলে আনা হচ্ছে। এই যুক্তি মার্কিন জনসাধারণের কাছেও গ্রহণযোগ্য ছিলো না, কারণ আমাদের যৌথ কমাণ্ড ১১ই ডিসেম্বর থেকে বিমান হামলা সাময়িকভাবে স্থগিত রেখে ঢাকা বিমানবন্দর মেরামতের সুযোগ করে দেয়। যাতে আন্তর্জাতিক পথের বিমানগুলোতে বিদেশী নাগরিকরা ঢাকা ত্যাগ করতে পারেন। কিন্তু মার্কিন নাগরিকদের মধ্যে এ সময়ে ঢাকা ত্যাগের তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি।
ততক্ষণে যুদ্ধ সম্পর্কে সবাই স্পষ্ট ধারনা করতে পারছিলো। যৌথবাহিনী সাফল্যের সাথে মেঘনার ওপারে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণের পর সামরিক বিশেষজ্ঞরা অভিমত প্রকাশ করেছিলেন সাত থেকে দশ দিনের মধ্যে ঢাকার পতন ঘটবে। নিয়াজী অবশ্য তখনো নিরাপদে ঢাকায় বসে হুংকার দিচ্ছিলেন, প্রতি ইঞ্চি জায়গার জন্য একটি প্রাণ বেচেঁ থাকা পর্যন্ত আমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাবো। রাও ফরমান আলী কিন্তু ঠিকই বুঝেছিলেন। খেলা শেষ। বাংলাদেশে পাকিস্তানীরা যে জঘন্য অপরাধ করেছিলো, অপারেশন জেনোসাইডের অন্যতম স্তপতি ফরমান আলী সে বিষয়ে পুরো সচেতন হয়ে পড়েছিলেন। পরাজয় তখন অবশ্যম্ভাবী। মুক্তিবাহিনীর হাত থেকে রক্ষ পাবার উদ্দেশে ১১ই ডিসেম্বর তিনি যুদ্ধ বিরতির জন্য জাতিসংঘ সদর দফতরে এক আবেদন জানান। ফরমান আলী এখনকার সকল পাকিস্তনীকে অপসরণের ব্যবস্থা করারও অনুরোধ করেন। সঙ্গে সঙ্গে ইয়াহিয়া খান জাতিসংঘকে জানিয়ে দেন যে, ফরমান আলীর প্রস্তাব অনুমোদিত। ইয়াহিয়ার তখনো আশা, যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন তাকে উদ্ধার করতে নিশ্চয়ই এগিয়ে আসবে। নিয়াজীকে তিনি আরেকটু অপেক্ষা করার জন্য নির্দেশ দেন।
চীন বেধহয় একা অজুহাতের জন্যই অপেক্ষা করছিলো। আর ৪ঠা ডিসেম্বর মার্কিন ৭ম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করে।
চট্রগ্রাম সেক্টরে আমাদের সকল সৈন্য ৯ই ডিসেম্বর বিকালের মধ্যে শুভপুর সেতু বরাবর ফেনী নদী পার হয়ে যায়। সামনে শত্রুরা কোথায় কি অবস্থায় আছে পর্যবেক্ষণের জন্য আমরা যথারীতি টহলদার দল আগেই পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। পাকিস্তানীরা মিরেশ্বরাই ছেড়ে যাচ্ছে বলে ১০ই ডিসেম্বর একজন গেরিলা বেস কমাণ্ডার আমাকে খবর দেয়। মিরশ্বরাই থেকে ১৫ মাইল দূরে গিয়ে সীতাকুণ্ডুতে তারা নাকি নতুনভাবে অবস্থান গ্রহণ করেছে। আমি সাথে সাথে মিরেশ্বরাই দখল করার জন্য একটি ব্যাটালিয়ন পাঠিয়ে দেই। তখনো আমাদের কোনো যানবাহন ফেনী নদী পার হতে পারেনি। ব্যাটালিয়নের সৈন্যদের তাই পায়ে হেঁটেই অগ্রসর হতে হচ্ছিলো। ভারী অস্ত্রশস্ত্র ও মালপত্র নেওয়ার জন্য কয়েকটি রিকশা ও গরুর গাড়ি জোগাড় করা হয়।
বিকেলে আমি পরিষদ সদস্য মোশাররফ হোসেনকে নিয়ে একখানি রিকশায় মিরেশ্বরাইয়ের দিকে যাত্রা শুরু করি। আমাদের ব্যাটালিয়নও তখন একই দিকে মার্চ করে যাচ্ছিলো। পথে তাদের পেছনে ফেলে আমরা এগিয়ে যাই। অবশ্য এই ভাবে একা সামনে এগিয়ে যাওয়া ছিলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। পাকিস্তানীরা ঠিক কোথাও রয়েছে কিনা তখনো আমরা তা জানতাম না। তারা সকলেই মিরেশ্বরাই ত্যাগ করেছে কিনা তারও কোনো নিশ্চয়তা ছিলো না। তবু আমি ঝুঁকিনিয়ে মিরেশ্বরাই পৌছে দেখি একটু আগে শত্রুসেনারা সে স্থান ছেড়ে চলে গেছে। স্থানীয় কয়েকজন কর্মকর্তা মিরেশ্বাই হাইস্কুল ভবনে আমার সাথে একত্র হলেন। পাকিস্তানীরা আবার রাতে ফিরে আসতে পারে বলে তারা আশংকা করছিলেন। আমাদের তখন অত্যন্ত দ্রুত চট্টগ্রাম দখল করা দরকার। তাই মিরেশ্বরাইতে আমরা দ্রুত প্রতিরক্ষা অবস্থান গড়ে তুললাম। এপ্রিল ও মে মাসে এই