পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৬১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
36

অঞ্চলেই আমরা যুদ্ধ করেছিলাম, তাই পুরো এলাকাটি আমার এবং আমার অধিকাংশ সৈন্যেও কাছে ছিলো সুপরিচিত। মিরেশ্বরাইতে আমরা বেসামরিক প্রশাসন চালু করি। করেরহাটে অবস্থানরত ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার আনন্দ স্বরুপকে আমার নতুন অবস্থানের কথা জানিয়ে তাঁকে সত্বর এখানে চলে আসার অনুরোধ জানাই। চট্টগ্রামের পথে শত্রুসেনার সঠিক অবস্থান জানার জন্য একটি টহলদার দলকে পাঠিয়ে দেই মিরেশ্বারই থেকে সীতাকুণ্ডের দিকে। ভোরেই আবার যাত্রা শুরু করতে হবে। তাই মিরেশ্বরাই হাই স্কুলে সে রাতটা কাটালাম।

 পরের দিন স্বল্পকালীন সংঘের্ষের পারই সীতাকুণ্ডে শত্রুদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। সীতাকুণ্ড অতিক্রম করার পর ১৩ই ডিসেম্বর কুমিরায় পৌছে আমরা পাকিস্তানীদের শক্তিশালী ঘাঁটির সম্মুখীন হই। ভূমি বৈশিষ্ট্যের কারণে এই জায়গাটি শত্রুদের খুবই অনুকূলে ছিলো। পশ্চিমে সাগর এবং পূর্বে উঁচু পাহাড়ের মধ্যবর্তী সরু এলাকা জুড়ে পাকিস্তানীদের সুদৃঢ় অবস্থান নিয়ে বসেছিলো। সড়কের এক স্থানে গভীর খালের ওপর সেতুটি ওরা ধ্বংস করে দিয়েছিলো। রাস্তার ওপর প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা ছাড়াও পার্শ্ববর্তী উঁচু পাহাড়ে যক্ষ্মা হসপাতালের কাছে ছিলো তাদের মূল প্রতিরক্ষা ঘাঁটি। পরবর্তী চব্বিশ ঘণ্টা উভয় পক্ষে তুমুল সংঘর্ষ হয়। আমাদের কয়েকজন সংঘর্ষে হতাহত হলেও পরদিন সকালের মধ্য আমরা পূর্বদিকে অগ্রসর হতে সক্ষম হই। বেসামরিক জনসাধারণ শত্রুসেনাদের অবস্থান সম্পর্কে আমাদের খরাখবর দিচ্ছিলো। সংবাদ অনুযায়ী সঠিক লক্ষ্যস্থলের ওপর কামান দেগে ওদের ঘায়েল করছিলাম। ১৪ই ডিসেম্বর ভোর রাত ৩টায় আমরা কুমিরা পুরোপুরি শত্রুমুক্ত করে ফেলি। চট্টগ্রাম এখন মাত্র ১২ মাইল দূরে। কুমিরা মুক্ত হওয়ার মাত্র ৩ ঘণ্টার মধ্যে আমাদের যানবাহন এবং কামানগুলো ভাঙা সেতু এড়িয়ে খাল পার হতে শুরু করে। কয়েক হাজার নারী, পুরুষ ও শিশু ভাঙা সেতুর কাছে জমায়েত হয়ে আমাদের সাহায্য করেছিলো। একদল খালের খাড়া পার কেটে ডাইবারসন রোডের ব্যবস্থা করছিলো। অন্য দল আবার গাছ, পাথর, মাটি যা কিছু পাচ্ছিলো তাইদিয়ে খাল ভরে ফেলার চেষ্টা করছিলো। আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখছিলাম। এই সময় এক বৃদ্ধা আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, বাবা, চিন্তা করো না। এ কাজ আমরাই পারবো। দ্যাকো তোমাদের মালপত্র আর গাড়ি-ঘোড়া কিভাবে পার করার বন্দোবস্ত করছি। দরকার হলে আমরা সবাইখালে শুয়ে পড়বো। আর তার ওপর দিয়ে তোমাদের গাড়ী পার করার ব্যবস্থা করবো। দেরি করো না বাবা। প্রত্যেক মুহূর্তে তারা আমাদের লোক মারছে। বৃদ্ধা একটু থামলেন। তার দুই চোখ পানিতে ভরে গেছে। বৃদ্ধা বলে চললেন, তোমরা জানো না, কিছুদিন আগে ঈদের সময় চাটগাঁওয়ে একটি লোকাল ট্রেন থামিয়ে তারা সকল বাঙালী যাত্রীকে খুন করেছে। প্রায় এক হাজার হবে। দা ছুরি এসব দিয়ে মেরেছে। আমার মেয়ে আর নাতি নাতনিও ছিলো আর বলতে পারবো না তোমরা এগিয়ে যাও, তাড়াতাড়ি এগিয়ে যাও। তিনি আমাকে প্রায় ঠেলে দিয়েই আবার কাজে ফিরে গেলেন। আমিও পাকিস্তানীদের এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কথা শুনেছিলাম। তবে চট্টগ্রামের সর্বশেষ যে খবর আমি পেয়েছিলাম, তা ছিলো আরো ভয়াবহ। পাকিস্তানী সামরিক জান্তা এবং অবাঙালিরা সম্মিলিতভাবে পরিকল্পনা করেছিলো চট্টগ্রাম শহরের কয়েক হাজার বাঙালীকে নির্বিচারে হত্যা করতে। এটা ছিলো তাদের শেষ মরণ কামড়।

 ততোক্ষণে বঙ্গোপসাগরে ৭ম নৌ-বহরের অনুপ্রবেশে পরিস্থিতি বেশ জটিল হয়ে উঠেছিলো। চট্টগ্রামের কোন সমুদ্র উপকূলে টাস্কফোর্স-এর মার্কিন বাহিনী অবতরণ করতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছিলো। তাই যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব আমরা চট্টগ্রাম মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেই। সেই উদ্দেশ্য ভারতের ২৩ ডিভিশনের ৮৩ ব্রিগেড লাকসাম থেকে দ্রুত যাত্রা শুরু করে এবং কুমিরার কাছে আমাদের সাথে যোগ দেয়। অন্যদিকে ভারতের বিমানবাহিনী ও ইস্টার্ন ফ্লিট পাকিস্তানী অবস্থানগুলোর ওপর অবিরাম বোমাবর্ষণ করে চলেছিলো। এখানকার পাকবাহিনীকে ধ্বংস করা এবং পোর্ট অচল করে দেয়ার জন্যই এই আক্রমণ চলছিল। বোমার আঘাতে জ্বালানি তেলের ট্যাংকগুলো কয়েকদিন ধরে জ্বলছিল। ক্ষতিগ্রস্ত এবং নিমজ্জিত জাহাজের সংখ্যাও ছিল প্রচুর। ডুবন্ত চ্যানেল প্রায় পুরোপুরি বন্ধ। পোর্টের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিলো ব্যাপক। ৫০০ এবং ১০০ পাউণ্ড বোমার গর্তগুলোর ভরাট এবং ধ্বংসস্তূপ পরিস্কার করতে পরে সময় লেগেছিলো এক বছরেরও বেশি।