পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৬৫

উইকিসংকলন থেকে
পরিভ্রমণে চলুন অনুসন্ধানে চলুন
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
40

 সুবেদার আজিজ এবং ১৫ বছরের সেই ছেলেটি দুজনই গোলার আঘাতে আহত হলো। আস্তে আস্তে পশ্চিম আকাশে সূর্য ডুবে গেল, সেই সাথে বাতাসে মিলিয়ে গেলো তাদের শেষ নিঃশ্বাস। তখন সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। একজন পাকিস্তানী মেজর ভাটিয়রীর ভাঙা ব্রিজের মুখে এসে দাঁড়ালো। হাতে তার শাদা পতাকা। তারা নিয়াজীর নির্দেশ পেয়ে গেছে, এখন আত্মসমর্পণ করতে চায়।

পরিশেষ

 রণাঙ্গণে এবার নেমে আসে প্রশান্ত নীরবতা।

 রাইফেল, মেশিনগান, মর্টার, কামানের গোলাগুলির শব্দ থেমে যায়। থেমে যায় আহতের কান্না, মুমূর্ষের করুণ আর্তনাদ। নতুন এই রাত্রির প্রহর আসে কোন এক হারানো অতীতের শান্তির স্বপ্ন নিয়ে। এমনি সুন্দরের স্বপ্নে আবহমানকাল ধরে মানুষের সংগ্রাম চলেছে।

 ভাটিয়ারীতে মহাসড়কের ওপর সেতুটি পাকিস্তানীরা ধ্বংস করে দিয়েছিলো। হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা আর স্বেচ্ছাসেবক ১৬ই ডিসেম্বর সারারাত কাজ করলো ভাটিয়ারীর খালের মধ্য দিয়ে একটা বিকল্প রাস্তা তৈরী করতে। রাতেই আমরা সমস্ত সৈন্য এবং গেরিলাদের চট্টগ্রাম শহরে এবং চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য এলাকায় নিয়ন্ত্রণ্ডার গ্রহণ করার দায়িত্ব বুঝিয়ে দেই। ফেনীর অংশবিশেষসহ শুভপুর পর্যন্ত এলাকার নিয়ন্ত্রণভার আমরা আগেই নিয়েছিলাম। আমার সম্পূর্ণ বাহিনীকে পর দিন খুব সকাল বেলায়ই চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ করে গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহের নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণের নির্দেশ দিলাম। একটি ব্যাটালিয়নকে অবশ্য রাতেই খাল পার হয়ে শহর অভিমুখে যতোদূর সম্ভব এগিয়ে অবস্থান গ্রহণ করতে পাঠিয়ে দেই।

 শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত সার্কিট হাউসকে আমার হেডকোয়ার্টার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। পাকিস্তানী সৈন্যদের নির্দেশ দেওয়া হলো পোর্ট এলাকায় নৌবাহিনীর হেড কোয়ার্টার এবং চট্টগ্রাম ক্যাণ্টনমেণ্টে আত্মসমর্পণের জন্য জমায়েত হতে। পাকিস্তানী বন্দীদের দায়িত্ব ভারতীয় সেনাবহিনীর উপর ন্যস্ত হয়। চট্টগ্রামে পাকিস্তানী সেনাবহিনীর ১৬১ জন অফিসার, ৩০৫ জন জেসিও এবং নৌ ও বিমান বাহিনী সমপর্যায়ের লোক এবং তিন বাহিনীর ৮,৬১৮ জন সৈন্য আত্মসমর্পণ করে।

 ১৭ই ডিসেম্বর ভোর পর্যন্ত বিকল্প রাস্তার কাজ সম্পন্ন হলো না। ফলে তখন পর্যন্ত সে স্থান দিয়ে গাড়ী পার করাও সম্ভব ছিল না। আমি পুলের এপাড়ে গাড়ী থেকে নেমে পড়লাম একটা ছোট প্যাকেট হাতে নিয়ে। তারপর একটা লাঠিতে ভর দিয়ে খাল পার হয়ে ওপারে গিয়ে উঠলাম। দুদিন আগে কুমিরার যুদ্ধে আহত হওয়ায় আমাকে লাঠিতে ভর দিয়ে বেশ খুঁড়িয়ে চলতে হচ্ছিলো।

 পাকিস্তানীদের আত্মসম্পর্ণের ব্যাপেরে লোকজন তখনো পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারেনি। তা সত্ত্বেও শহরের কিছু লোক আমাদের এগিয়ে নেয়ার জন্য ভাটিয়ারীর ভাঙা সেতু পর্যন্ত এগিয়ে এসেছিলাম। আমি আমার এক বন্ধুর গাড়ীতে উঠে বসলাম। গাড়ী ছুটে চললো সোজা সার্কিট হাউসের দিকে।

 অগণিত নারী-পুরুষ রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে। পথের দুই ধারে দাঁড়িয়ে তারা হাত তুলে যৌথ বাহিনীর সৈন্যদের এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অভিনন্দন জানাচ্ছিলো। জয় বাংলা ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে। কেউ কেউ বোধ হয় তখনো পুরো বিশ্বাস করতে পারেনি যে সত্যিই যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। ভয়ে ভয়ে বাড়ির ভেতর থেকে উঁকি দিয়ে তারা সেই অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখছিল। পাকিস্তানীদের তখন অস্ত্র সংবরণের পালা। বাস ও ট্রাকে করে তারা দ্রুত ছুটে পালাচ্ছিলো নৌবাহিনীর হেডকোয়ার্টার এবং ক্যাণ্টনমেণ্টের দিকে।

 সার্কিট হাউস তখন বহু লোক জমা হয়ে গেছে। জনতার ভিড় ঠেলে আমি এগিয়ে যাই। যুদ্ধের এই কয় মাসে আবার দাড়ি বেশ বড় হয়ে যাওয়ায় অনেক বন্ধু এবং পরিচিতজনই আমাকে চিনতে পারলো না।